মো. সাদরুল আলম সিয়াম। ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে (মেধাক্রম ৯৫তম) সুপারিশপ্রাপ্ত হন। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বৈলর ইউনিয়নে। তিনি ত্রিশালের ধানীখোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি’ থেকে ‘ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্সে (ইঞ্জিনিয়ারিং)’ স্নাতক সম্পন্ন করেন।
Advertisement
বর্তমানে তিনি গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস জয়ের গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাম হোসাইন—
জাগো নিউজ: ছোটবেলা কোথায় কেমন কেটেছে?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: ছোটবেলা গ্রামেই কেটেছে। আমি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বৈলর ইউনিয়নে বড় হয়েছি। ছোট থেকেই খুব ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছিলাম। নবম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষার পর খেজুর গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ছিল। কিন্তু কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না, গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে! পড়াশোনায় বরাবরই মনোযোগী ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি, অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এসএসসিতে জিপিএ ৫ এবং এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। গ্রামের আবহে বেড়ে ওঠায় প্রচুর খেলাধুলা করতাম। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। আর্থিক অভাব-অনটনের কথা বাদ দিলে বলা যায়, ছোটবেলাটা অসাধারণ কেটেছে।
জাগো নিউজ: বিসিএস দেওয়ার সিদ্ধান্ত কখন নিলেন?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে সিঙ্গাপুরের এক বিদেশগামী জাহাজে চাকরি করার সময় প্রথম সিদ্ধান্ত নিই বিসিএস দেব। কিন্তু প্রস্তুতি শুরু করি ২০১৮ সালের অক্টোবরে ৪০তম বিসিএসের সার্কুলারের পর। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বাবা আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন।
Advertisement
জাগো নিউজ: বিশাল সিলেবাস, প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কীভাবে?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: বিসিএসের সিলেবাস অনেক বড়, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি প্রথমেই বিগত বিসিএসের প্রশ্নগুলো সমাধান করে ফেলি। এতে প্রশ্নের প্যাটার্ন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ৩৫তম বিসিএসের পর থেকে সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছে। আমি যেহেতু সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছিলাম; সেহেতু বিজ্ঞান ও গণিতে কিছুটা এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ততটাই পিছিয়ে ছিলাম! এখানে আমাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। অ্যানালাইসিস করে যে সেকশনগুলোয় বেশি প্রশ্ন আসে, সেখানে বেশি জোর দিয়েছি। অনেকেই বলেন রাত জেগে না পড়ে, সকালে উঠে পড়াশোনা করতে। এটি অবশ্যই ভালো। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। আমি রাত জেগে পড়াশোনা করতাম, দিনের বেলা ঘুমাতাম।
বিসিএস প্রস্তুতিতে ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই। আপনার স্ট্রং জোনকে কাজে লাগাতে হবে। প্রিলিমিনারি প্রস্তুতিতে নেগেটিভ মার্কিং এবং টাইম ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে সতর্ক ছিলাম। লিখিত পরীক্ষার সিলেবাসও অনেক বড়। এখানে অনেকটা কৌশলী হতে হয়েছে। ইংরেজি, গণিত ও মানসিক দক্ষতা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, বাংলাদেশ বিষয়াবলির মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও অর্থনীতি অংশ, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির কনসেপচুয়াল অংশগুলোতেই প্রায় ৫০০ এর বশি নাম্বার থাকে। এখানে নাম্বার উঠানো সহজ বিধায় এখানে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরীক্ষার খাতায় প্রাসঙ্গিক কোটেশন, ডাটা, চার্ট, চিত্র ইত্যাদি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। ভাইভায় চেষ্টা করেছি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে ও পজিটিভলি উপস্থাপন করতে। সেটা কাজে দিয়েছে।
জাগো নিউজ: বিসিএসের জন্য আপনি কী কী বই পড়েছেন?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রস্তুতিতে যে কোনো একটি প্রকাশনীর এক সেট বই অনুসরণ করা যেতে পারে। আমি একই বিষয়ের একাধিক বই না পড়ে যে কোনো একটি বই বারবার পড়ার পক্ষপাতী। আমি মাধ্যমিকের বাংলা ব্যাকরণ, গণিত, উচ্চতর গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি, সাধারণ বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি এবং উচ্চ মাধ্যমিকের উচ্চতর গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, পদার্থবিজ্ঞান বইগুলো থেকে রিলেটেড টপিকগুলো পড়েছিলাম। এ ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ড. সৌমিত্র শেখরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, ড. হায়াৎ মামুদের ভাষা শিক্ষা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন এবং মুক্তিযুদ্ধ রিলেটেড বিভিন্ন বই পড়েছি। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই পড়েছি।
জাগো নিউজ: পথচলায় কার অনুপ্রেরণা সব সময় পাশে ছিল?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: বিসিএস পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বাবা। পরিবার সব সময় পাশে ছিল। কাছের মানুষজন সব সময় অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এ পর্যন্ত আসা প্রায় অসম্ভব ছিল। মাঝেমধ্যে অনেকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ব্যবহার পাইনি। খারাপ লেগেছে, হতাশ হয়েছি কিন্তু ভেঙে পড়িনি। নতুন উদ্দমে শুরু করেছি। এটাই মনে হয় জীবন! সব সময় প্রত্যাশিত ঘটনা আমাদের সাথে ঘটবে না। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখতে হবে, নিয়মিত প্রার্থনা করতে হবে। যা ঘটে ভালোর জন্যই ঘটে। আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন বলেই এ জায়গায় আসতে পেরেছি।
Advertisement
জাগো নিউজ: এত চাকরি থাকতে সিভিল সার্ভিসে কেন এলেন?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: বাংলাদেশ সিভিস সার্ভিস বর্তমানে সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় খুবই আকর্ষণীয় চাকরি। আমার ক্ষেত্রে আমি এসব বিবেচনায় নিইনি। আমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রফেশনে ছিলাম। সামনে অনেক অর্থ উপার্জনের এবং অনেক দেশ ভ্রমণের সুযোগ ছিল। সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করার সময় মাথায় আসে, ক্ষুদ্র এ জীবনে অর্থ উপার্জনই সব কিছু নয়! আমি যদি প্রত্যক্ষভাবে মানুষের জন্য, দেশের জন্য কাজ করতে পারি, এর থেকে বড় কিছু হতে পারে না। আমার জীবনে অনেক মানুষের অবদান আছে। আমিও ঠিক সেভাবেই মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রত্যক্ষভাবে মানুষের ও দেশের সেবা করার জন্য বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার থেকে বেশি সুযোগ খুব কম পেশায়ই আছে।
জাগো নিউজ: কীভাবে দেশের সেবা করতে চান?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ এটা আমি সব সময় মনে রাখি এবং বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব। প্রশাসন আগের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক এবং গতিশীল হয়েছে। ‘Service at your doorstep’ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এটিকে আরও বেগবান করতে চাই। সামনে আমাদের দুটো বড় বড় টার্গেট আছে। ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ২০৪১ সালে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের অংশীদার হতে চাই।
জাগো নিউজ: নতুন যারা বিসিএস পরীক্ষা দিতে চান, তদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?মো. সাদরুল আলম সিয়াম: বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি দরকার সেটি হচ্ছে ধৈর্য। আমি প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হয়েছি। তা-ও সার্কুলার থেকে নিয়োগ পর্যন্ত প্রায় ৪ বছরের বেশি সময় লেগেছে। এখন পিএসসি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সময় কমিয়ে আনার। তারপরও আপনাকে ধৈর্য ধরার মানসিকতা রাখতে হবে। বিসিএস প্রস্তুতিতে নামলে এমনভাবে প্রস্তুতি নেবেন, যাতে প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হতে পারেন। ‘পরের বার ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেব’ এরকম বাস্তবে হয়ে ওঠে না। ক্যারিয়ারে অবশ্যই ব্যাকআপ প্ল্যান রাখবেন। দিন শেষে প্রতি ব্যাচে প্রায় ২০০০ জনই বিসিএস ক্যাডার হবেন। বাকিদের বিকল্প ক্যারিয়ার বেছে নিতে হবে!
এসইউ/জেআইএম