কালের গর্ভে হারিয়ে গেলো আরও একটি বছর। তবে রেখে গেছে ঘটনাবহুল অনেক স্মৃতি। বিদায়ী বছরে আধ্যাত্মিক রাজধানীখ্যাত সিলেটের কয়েকটি ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত ছিল।
Advertisement
এর মধ্যে বেশি আলোচনায় ছিল মে থেকে জুন মাসের মধ্যে দুদফা বন্যা। এর ফলে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সিলেট। স্রোতের তোড়ে বিধ্বস্ত হয় ঘরবাড়ি। পানিতে তলিয়ে যায় শহর-বন্দর, গ্রামের পর গ্রাম। বিভাগের ৮০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
প্রাণে বাঁচতে উঁচু স্থানে গবাদি পশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে দিনযাপন করে বন্যার্ত মানুষ। ভয়াল বন্যায় বহুদিন সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রায় মাসখানেক বিভিন্ন জেলা শহর ও উপজেলা ছিল বিদ্যুৎহীন। সপ্তাহজুড়ে নেটওয়ার্কহীন ছিল পুরো সিলেট। ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণে বাঁচতে যেন এক টুকরো শুকনো মাটির সন্ধানে ছুটাছুটি করছিল বন্যার্ত মানুষ। সিলেট নগরীতে চলাচল করে নৌকা।
সরকারি হিসাবে সিলেটে বন্যাকবলিত হয়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছিলেন। ৪০ হাজার ৯১টি ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এর দ্বিগুণ মানুষ পানিবন্দি হন বলে জানা গেছে।
Advertisement
স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার চার লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি। এছাড়া দু’দফা বন্যায় ফসলি জমি ও মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকারি হিসাবে, সিলেট বিভাগে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলাভিত্তিক মৃত্যু সংখ্যায় শীর্ষে ছিল সুনামগঞ্জ। এ জেলায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া সিলেট জেলায় ১৮ জন, হবিগঞ্জে পাঁচজন এবং মৌলভীবাজারে ছয়জন মারা যান।
স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় প্রাণ হারান বহু মানুষ। বিপর্যস্ত সিলেটের মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর প্রধান হেলিকপ্টারে সিলেটে ছুটে আসেন। আবাসন, বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে পড়েন সাধারণ মানুষ। ত্রাণ নিয়ে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ জাতিসংঘ, ইউরোপি ইউনিয়ন, ব্রিটিশ সরকারসহ মানুষের পাশে মানবতার হাত বাড়ান অনেকেই।
বন্যার ধকল কাটতে না কাটতে শুরু হয় দাবদাহ। সিলেটের ওসমানীনগরে একটি বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ পাঁচজনকে উদ্ধার করা হয়, যাদের চারজন মারা যান। বেঁচে থাকেন একমাত্র এক ছেলে।
বছরের শুরুতেই সংকটে পড়ে সিলেটের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রীদের সঙ্গে প্রভোস্টের দুর্ব্যবহারের প্রতিকার চাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা হয়। শুরু হয় উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের ১৬৩ ঘণ্টার অনশন ভাঙাতে সিলেট আসেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক।
Advertisement
প্রায় ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত হয় সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির সম্মেলন ও কাউন্সিল। এছাড়া বিপিএল ফুটবলে মাতে সিলেটবাসী। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দাম নিয়ে বিরোধে সিলেটে চলে চার দিনের মাংস বিক্রেতাদের ধর্মঘট।
সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে রায়হান উদ্দিন (৩৩) নামের যুবক হত্যা মামলায় ওই ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়াসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ১৮ এপ্রিল শুরু হয় বিচার কাজ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনপ্রিয় লেখক শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা মামলায় প্রধান আসামি ফয়জুল হাসানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
৩০ এপ্রিল মধ্যরাতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলির সদস্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী ভাষাসৈনিক আবুল মাল আবদুল মুহিত না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। সর্বজন গ্রহণযোগ্য এই ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে সিলেটে নেমে আসে শোকের ছায়া।
প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট বিকেএসপিতে নির্মাণ হয় আন্তর্জাতিক মানের সিনথেটিক ফুটবল টার্ফে। যা শীত বৃষ্টি সব মৌসুমেই থাকবে ফুটবল প্রশিক্ষণের উপযোগী।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে সিলেটে কর্মবিরতি শুরু করেন চা শ্রমিকরা। সিলেটের চা-শ্রমিকদের ১৯ দিনের টানা কর্মবিরতি সংকটে ফেলে পুরো চা-শিল্পকে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ১৭০ টাকা মজুরি মেনে নিয়ে কাজে ফিরেন চা শ্রমিকরা। ভিডিও কনফারেন্সে সরাসরি চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এটাকে নিজের পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার বলে স্বীকৃতি দেন চা-শ্রমিকরা।
সেপ্টেম্বরে যৌন হয়রানির অভিযোগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়।
৬ নভেম্বর রাত ৯টায় নগরের আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় নিজ প্রাইভেটকারে বসা অবস্থায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন সিলেটে জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামাল (৪২)। খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি মুখোমুখি অবস্থান নিলে উত্তপ্ত হয় রাজনৈতিক পরিবেশ।
১৯ নভেম্বর সিলেটে সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে ঘিরে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে দু দিনের জন্য কার্যত অচল হয়ে পড়ে সিলেট। দুদিন আগ থেকে মাঠে বিএনপি নেতকার্মীরা অবস্থান নিয়ে দলীয় কর্মসূচি সফল করেন।
বিএনপির সরকারবিরোধী এই কর্মসূচি সফলে সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট সিটি করপোরেশনের গাড়ি, পানি ও ভিআইপি টয়লেট সুবিধা প্রদান ও জনবল ব্যবহার করে বিতর্কের জন্ম দেন।
এসজে/জেআইএম