আন্তর্জাতিক

জ্বালানির নতুন উৎসের চাহিদা আফ্রিকার অর্থনীতির বড় সুযোগ

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার মালাউইয়ের রাজধানী লিলংগুয়ের একটি বাজারে শুকনো মটরশুটি বাটিতে নিয়ে ২৬ বছর বয়সী ব্যবসায়ী অ্যানক বান্দা বলছিলেন, ‘আমরা সংগ্রাম করছি’। আবেগজড়িত কণ্ঠে বান্দা বলেন, কম লোকের কাছেই খরচ করার মতো অর্থ আছে এবং কৃষকরাও স্বাভাবিকের চেয়ে কম সরবরাহ করছেন।

Advertisement

বাজারটি থেকে খুব দূরে নয়, গাড়ির দীর্ঘ লাইন ফিলিং স্টেশন থেকে আশেপাশের রাস্তা পর্যন্ত চলে গেছে। কেননা, চালকরা জ্বালানির জন্য সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ডিজেল নিতে আসা অপেক্ষায় থাকা লরিগুলো তিন দিনেও এক মিলিমিটারও সরেনি৷ এখানেও, আফ্রিকার অনেক অংশের মতো, ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যেরও দাম।

সাব-সাহারান আফ্রিকানদের ৬০ শতাংশের বেশি লোক ছোট ছোট খামার আর জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রধানত তারা যা জন্মায় তাই খেয়ে বেঁচে থাকেন। কিছু দেশে যেমন মালাউইর, জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই কৃষক। যদি বড় মাপের কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে সাব-সাহারান আফ্রিকা সামগ্রিকভাবে তার প্রয়োজনীয় খাদ্যের ৯৪ শতাংশ উৎপাদন করে। এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক পরিসরে খুব কম শস্যের ব্যবসা করে।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নাইজেরিয়ার মতো কিছু দেশ বড় খাদ্য আমদানিকারক ও বিশ্ববাজারে দাম পরিবর্তনের ওপরও নির্ভর করে। মিশর ও সুদানও বিশেষভাবে প্রভাবিত কারণ তারা যা খায় তার প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করতে গমের আমদানির ওপর নির্ভর করে। তবুও খাদ্যের দাম শুধু এই দেশগুলোতে নয়, প্রায় সমস্ত সাব-সাহারান আফ্রিকাজুড়ে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে প্রধান খাদ্যের দাম গড়ে ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে জন্মানো খাবারও অন্তর্ভুক্ত। ঘানায় কাসাভার দাম বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। ২০২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মালাউইতে প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের খাদ্যের অভাব ছিল। জাতিসংঘ তার খাদ্য-নিরাপত্তা স্কেলে মানবিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবে এমন স্তরের মাত্র এক ধাপ নিচে ছিল দেশটি। সেই সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়ছে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে মালাউইতে প্রায় পাঁচজনের মধ্যে একজনের খাদ্যের অভাব হবে যতক্ষণ না এপ্রিল বা মে মাসে জাতীয় ফসল তোলা শুরু হয় সেখানে। একই ধরনের প্রবণতা মহাদেশের বেশিরভাগ অংশজুড়ে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে আফ্রিকার প্রায় ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ কিছু পরিমাণে খাদ্যের অভাব বোধ করেছিল। বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলছেন, এই সংখ্যা ২০২৩ সালে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।

Advertisement

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাবারের দাম কেন এত দ্রুত বেড়েছে এবং কেন এটি ২০২৩-এ চলতে থাকবে তা বোঝার জন্য তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পরিবহন ও সারের খরচ বাড়িয়েছে। অথচ উভয়ই কৃষিতে অপরিহার্য উপকরণ। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে আফ্রিকার অনেক অংশে সারের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। লাখ লাখ জীবিকা নির্বাহকারী কৃষক, যারা অধিকাংশ সময়ে নগদ অর্থের অভাবে ভুগেছে এবং তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।

ভেলে আফ্রিকা নামের একটি পরামর্শক সংস্থা বলছে ‘আমরা সম্ভবত ২০২৩ সালে সারের ঘাটতির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব দেখতে পাবো’। বর্তমানে যে খাবার খাওয়া হচ্ছে তা ৪ থেকে ৬ মাস আগে উৎপাদন করা হয়েছিল এবং এক বছর আগে কেনা সার ব্যবহার করা হয় এসব খাদ্য উৎপাদনে।’ তবে গ্যাস ও সার ২০২৩ সালে আফ্রিকাকে সুযোগ করে দিতে পারে। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী আবিষ্কৃত সমস্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশের কম আফ্রিকায় মিলেছে। ফলে মহাদেশটি এখন বিশ্বের প্রাকৃতিক-গ্যাসের মজুদের ১৩ শতাংশ ধারণ করে। ধনী জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) বলছে, তবে কম সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে তারা।

রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণে ইউরোপের নজর এখন আফ্রিকার দিকে। ইউরোপে গ্যাস পাঠাতে চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপলাইন নির্মাণে সমঝোতা পত্রে সই করে আফ্রিকার তিন দেশ। এই পাইপলাইন যাবে সাহারা মরুভূমির ওপর দিয়ে। আলজেরিয়ায় গ্যাস যাওয়ার পর তা হয় ভূমধ্যসাগরের নিচে পাইপলাইন দিয়ে অথবা এলএনজি ট্যাঙ্কারে করে ইউরোপে পৌঁছাবে। মিশর ইউরোপে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আরও চালান পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং মৌরিতানিয়া ও সেনেগালে নতুন এলএনজি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্প স্থগিত ছিল সেগুলো এখন গতিশীল করা হচ্ছে।

সর্বোপরি, আফ্রিকা আগামী বছরগুলোতে ইউরোপের প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানির ঘাটতি পূরণ করার অবস্থানে থাকতে পারে। যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো এতোদিন বিকশিত ছিল না সেগুলো এখন কার্যকর। সঠিক নীতি গ্রহণ করলে এগুলো গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে পারে। এই গ্যাস ২০২২ সালের প্রথম দিকে নাইজেরিয়ায় চালু হওয়া আফ্রিকার বৃহত্তম সার কারখানার মতো নতুন সার কারখানা চালু করতে পারে। নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে পারে যা কঠিন বছরে আলো নিয়ে আসবে।

Advertisement

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএনআর/এমএস