দেশজুড়ে

শেরপুরে দখল হচ্ছে বনভূমি, উজাড় হচ্ছে গারো পাহাড়

শেরপুরে প্রতিনিয়ত দখল হচ্ছে বনের জমি। দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের দোহায় দিয়ে জমি ছাড়ছেন না দখলদাররা। পাশাপাশি শতশত একর জমিতে চাষাবাদ করছেন অবৈধ বাসিন্দারা। এতে উজাড় হচ্ছে গারো পাহাড়ের বনভূমি ও বৃক্ষরাজি।

Advertisement

বন বিভাগের তথ্যমতে, শেরপুরের সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে পাহাড়ি বনভূমি। শেরপুর বন বিভাগ তিনটি রেঞ্জে বিভক্ত। ওই তিনটি রেঞ্জের অধীনে প্রায় ২১ হাজার একরের কাছাকাছি বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে রাংটিয়া রেঞ্জে ৮ হাজার ৮৮০ একর, মধুটিলা রেঞ্জে ৪ হাজার ২৩৫ একর এবং বালিজুড়ি রেঞ্জে ৭ হাজার ৫৮৫ একর বনভূমি রয়েছে। বন বিভাগের এই বিশাল জমির প্রায় ১৫ শতাংশই এখন দখলদারদের হাতে।

তিনটি রেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাংটিয়া রেঞ্জে ১ হাজার ৪৬৬ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। এছাড়া বালিজুড়ি রেঞ্জের আওতায় ৪৭৭ দশমিক ৩৪ একর ও মধুটিলা রেঞ্জের আওতায় ৬০২ একর বনভূমি বেদখলে রয়েছে। এ বিশাল বনভূমি দখল করে আছেন প্রায় চার হাজার দখলদার। অবৈধ দখলে থাকা এসব বনভূমির মৌজাভিত্তিক বাজারমূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা হবে বলে জানাচ্ছে বন বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ দখলদাররা বাড়ি বানিয়ে বসবাসের পাশাপাশি পাহাড় কেটে তৈরি করেছেন চাষাবাদের জমি। সেখানে ধানসহ বিভিন্ন রকমের সবজি আবাদ করছেন তারা। এতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে অপার সৌন্দর্যের গারো পাহাড়। বনের মধ্যে মানববসতি গড়ে ওঠায় কমে গেছে বন্যপ্রাণীর বিচরণও।

Advertisement

একসময় এ গারো পাহাড়ের বনে বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, শূকর ও বনমোরগ থাকলেও এখন সেগুলো আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে আর দখলদারদের অত্যাচারে সেগুলো এ বন থেকে বিলুপ্তই হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রকাশ্যে বনের জমিতে অবৈধভাবে বসবাসের কথা স্বীকার করলেও দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের দোহাই দিয়ে জমি ছাড়তে চাইছেন না তারা। তবে বিকল্প ব্যবস্থা করে উচ্ছেদ করলে জায়গা ছাড়তে রাজি আছেন তারা।

রাংটিয়া এলাকার বাসিন্দা জিতার আলী বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে এখানে আইসা আমি বাড়ি করছি। আমার তো আর কোথাও জায়গাজমি নাই। এখন আমগরে এইখানে থাকতে না দিলে কই থাকমু।’

মো. নাজমুল হক নামে আরেক অবৈধ দখলদার বলেন, ‘১৯৬৪ সালে ভারত থেকে এইখানে আইসা বাড়ি করছি। আমরা তো বনে থাকবার চাই না। আমার জায়গাজমি না থাকায় বাধ্য হয়েই এইখানে থাকি। সরকার যদি আমাগো অন্য কোথাও থাকার জায়গা করে দেয়, তাহলে আমরা এই জায়গা ছাইড়া দিতে রাজি আছি।’

একই এলাকার দিলীপ মিয়া বলেন, ‘আমার বাপ-চাচারা এখানেই থাকতো। আমরা গরিব মানুষ তাই বনের মধ্যে থাকি। এখন যদি হঠাৎ কইরা আমগরে এখান থেকে উচ্ছেদ কইরা দেয়, তাহলে কই যামু। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, আমগরে এখান থেকে উচ্ছেদ করলে যাতে পুনর্বাসনের একটা ব্যবস্থা কইরা দেয়।’

Advertisement

গজনী এলাকার কৃষক মো. হেকমত আলী বলেন, ‘আমি বাপের কাছ থেকে এই জায়গা পাইছি। আমার বউ-পুলাপান লইয়া আমি এহন এই জাগাতি থাহি। এই গ্রামেই চাষাবাদ কইরা খাই। আমগোরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কইরা তুইলা দিলে আমরা যাইতে পারমু। নইলে রাস্তায় থাহা ছাড়া আমগোর উপায় নাই।’

মিনারা বেগম বলেন, ‘সরকার যদি আমগোরে একটা বিধি ব্যবস্থা কইরা দেয় তাহলে আমরা এখান থেকে যামুগা। জন্ম থেকেই এখানে থাকতাছি। আমগর অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা না কইরা উচ্ছেদ করলে থাকমু কই?’

অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের জেলা শাখার আহ্বায়ক মো. মেরাজ উদ্দিন বলেন, প্রতিনিয়তই গারো পাহাড়ের বনের জমি দখল হচ্ছে। এতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বনভূমি। দখলদাররা বনের গাছপালা কেটে বসতবাড়ি নির্মাণসহ চাষাবাদ করছে। তাই বনের বেদখল জমি উদ্ধারে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন ও বনবিভাগের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোহাম্মদ আবু ইউসূফ বলেন, জবর দখল করা জমি উদ্ধার করে সেখানে প্রতি বছরই বনায়ন করার কার্যক্রম চলমান আছে। উচ্ছেদ মোকদ্দমার পাশাপাশি প্রত্যেকটা রেঞ্জ ও বিট অফিস থেকে দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।

শেরপুরের জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, শেরপুর জেলার জন্য বনভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেলার বিস্তীর্ণ বনভূমিতে থাকা অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের অভিযান চলমান আছে। আর শেরপুর বন বিভাগের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রমে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়।

এমআরাআর/জিকেএস