জাতীয়

নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না মানবপাচার মামলা

মানবপাচার আইনের মামলাগুলো ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে আইনে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর মামলা নিষ্পত্তি করতে ১৮০ কার্যদিবসের কথা বলা হয়েছে। অথচ নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ মামলার তদন্ত বা নিষ্পত্তি হয় না। এতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলছে। নির্ধারিত সময় মামলা তদন্ত বা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক বাদী মামলা পরিচালনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে অপরাধীরা অপরাধ করতে আবারও সুযোগ পান।

Advertisement

২০২২ সালের নভেম্বরে মানবপাচার ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির হিসাবে দেখা যায়, ৯২৮টি মামলা বিচারাধীন। এগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর ও পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন ২২৭টি মামলা। ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার সময়সীমা থাকলেও পাঁচ বছর ধরে চলছে ২২৭টি মামলার বিচার। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে মামলা চললে ন্যায়বিচার থেকে ভিকটিম বঞ্চিত হবে। অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও সুযোগ পাবেন বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবীরা।

আইনে যা রয়েছে- ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ২৪ ধারার ১ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, আইনের অধীন সংঘটিত কোনো অপরাধের অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্য সম্পন্ন করবে। (২) উপ-ধারা (১) এর বিধান সত্ত্বেও উক্ত সময়সীমার মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে ব্যর্থতা বিচারকার্যকে বাতিল করবে না। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল উক্ত সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে সমর্থ না হলে কারণ ব্যাখ্যা করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন।

আরও পড়ুন: দেশে ফিরে নির্যাতনের কাহিনী শোনালেন পাচার হওয়া জাহাঙ্গীর

Advertisement

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তথ্য মতে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সারাদেশে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৪২৪টি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দিয়েছেন ৫৯৩টি মামলার। তদন্তে সত্যতা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৫৩ মামলার। এই চার বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৪৬টি মামলা। তদন্তধীন ৪৭৭৮টি। ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নিময় থাকলেও অধিকাংশ মামলার তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৫৬টি। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১৫৬টি মামলায়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১৭ মামলায়। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১৭৩টি। তদন্তধীন ১০৮৩টি। ২০১৯ সালে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৭১৯টি। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দিয়েছেন ৫৮টি মামলায়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন ৫ মামলায়। নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৩টি। তদন্তধীন ৬৫৬টি।

২০২০ সালে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৫১৩টি। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ৫৬টি মামলায়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে দুই মামলায়। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৮টি মামলা। তদন্তাধীন ৪৫৫টি। ২০২১ সালে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৮৮১টি। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ২১০টিতে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন ২১ মামলায়। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১২১টি। তদন্তাধীন ৯৩৪টি মামলা। ২০২২ সালে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৫টি। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১১৩টি মামলায়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৮ মামলায়। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৩৪টি। তদন্তাধীন ৯৩৪টি মামলা।

আরও পড়ুন: নৌকায় ভেসে ভেসে লিবিয়ার ‘গেম ঘরে’ আটকা কয়েকশ বাংলাদেশি

Advertisement

আইনে যা রয়েছে, ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ১৯ ধারার ৩ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, মানবপাচার আইনে করা মামলা দায়ের বা ট্রাইব্যুনাল থেকে তদন্তের নির্দেশ প্রাপ্তির অনধিক ৯০ (নব্বই) কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে।

র‌্যাবের হাতে আটক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য-ফাইল ছবি

২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ১৯ ধারার ৪ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন না হলে, তদন্ত কর্মকর্তা উক্ত সময়সীমা শেষ হওয়ার অন্তত তিন কার্যদিবস পূর্বে তাহার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা অথবা ট্রাইব্যুনাল হইতে তদন্তের নির্দেশ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, ট্রাইব্যুনালের নিকট সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য লিখিতভাবে আবেদন করবে। উক্ত নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা অথবা ক্ষেত্রমত, ট্রাইব্যুনাল উক্ত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত সম্পাদনে ব্যর্থতার জন্য প্রদর্শিত কারণে সন্তুষ্ট হলে তদন্তের সময়সীমা অতিরিক্ত ৩০ (ত্রিশ) কার্যদিবস বৃদ্ধি করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় তদন্তের ক্ষেত্রে কেবল ট্রাইব্যুনাল এই ধরনের তদন্তের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে পারবেন এবং উক্ত ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল তার স্বীয় বিবেচনায় যৌক্তিক মেয়াদে তদন্তের সময়সীমা বাড়াবেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের প্রধান উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচারের মামলা হলে এর আসামি আসলে সারাদেশে ছড়ানো ছিটানো থাকে। তাদের ভুয়া ঠিকানা থাকে। এনআইডি কার্ডও ভুয়া পাওয়া যায়। এগুলো যাচাই-বাছাই করে নিয়ে এসে সঠিক সময়ের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া একটি জটিল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। অনেক সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও পরিবর্তন হন। নতুন করে তদন্ত শুরু করেন। ফলে এই মামলার তদন্তে জট পড়ে। তদন্তে যেন জট না পড়ে এজন্য সিআইডিতে আলাদা করে একটি ইউনিটও করা হয়েছে। ডিএমপিতে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো আমরা তদন্তসাপেক্ষে দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার চেষ্টা করবো।

আরও পড়ুন: হজের আশ্বাসে সৌদি নিয়ে নির্যাতন, টার্গেট দরিদ্র-তালাকপ্রাপ্ত নারী

এ বিষয়ে ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেন, মানবপাচার মামলাগুলো আমরা খুব গুরুত্ব সহকারে দেখি। মামলা করার পর সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে হাজির হচ্ছেন না। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে। আমরা সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে চেষ্টা করছি। সাক্ষীরা আদালতে হাজির না হওয়ায় মামলাগুলো নিষ্পত্তিও করতে পারছি না।

মানবপাচারে অভিযোগে গ্রেফতার আসামিরা-ফাইল ছবি

আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন মামলা চললে ন্যায়বিচার থেকে ভিকটিমরা বঞ্চিত হন। সাক্ষীরা আদালতে এসে ঘটনা ভুলে যান। অনেক সময় মামলা পরিচালনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করলে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

আরও পড়ুন: মালয়েশিয়ায় পাচারে প্রতিবন্ধী তরুণীরা ছিল মা-মেয়ের টার্গেট

আইনজীবী খালেদ হোসেন বলেন, মানবপাচার মামলার আসামিরা খুবই প্রভাবশালী। তারা মামলা দীর্ঘায়ু করতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। অনেক সময় সাক্ষীদের হুমকি দেওয়া হয়। যাতে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হতে না পারেন। এতে আসামিরা একটা ভালো সুযোগ পেয়ে যান। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে এক সময় প্রভাবশালী আসামিরা খালাস পেয়ে যান। পরে তারা অপরাধ করতে সুযোগ পেয়ে যান। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা। প্রকৃত অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই পার না পান।

জেএ/এসএইচএস/জেআইএম