তামাকজাত পণ্য মানেই স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। সিগারেটে আসক্তি ক্রমে ডেকে আনতে পারে মৃত্যু। এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে সিগারেট ছেড়ে আসক্ত হন ই-সিগারেটে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-সিগারেট বরং সিগারেটের চেয়ে আরও বেশি ক্ষতিকর। ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে নিষিদ্ধ করেছে এই ইলেক্ট্রনিক সিগারেট। বাংলাদেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধে উদ্যোগ নিলেও আইন সংক্রান্ত জটিলতায় এখনো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট তামাক হিসেবে ব্যবহার হতো। দেশটিতে ২০২০ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩৬ লাখ শিক্ষার্থী ই-সিগারেট ব্যবহার করেছে। ২০২১ সালে ই-সিগারেটে আসক্ত ছিল প্রায় ২০ লাখ তরুণ।
এছাড়া জেএএমএ নেটওয়ার্ক নামে মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যেসব মানুষ ই-সিগারেট ব্যবহার করতো তার মধ্যে কিশোরের সংখ্যা ছিল এক শতাংশেরও কম। কিন্তু ২০১৭ থেকে ২০২১ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশে।
বাংলাদেশেও বাড়ছে ই-সিগারেট ব্যবহারবাংলাদেশেও ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। আমাদের দেশে ই-সিগারেট নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা না হলেও তামাকবিরোধী সংগঠনসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে ই-সিগারেট ও এর বিভিন্ন উপাদান উৎপাদিত না হলেও এর আমদানি-বিপণন নিষিদ্ধ নয়। বিভিন্ন বয়সী মানুষ বিশেষ করে তরুণরা ই-সিগারেটকে অনেকটা ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করছে। সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেটে ঝুঁকছেন অনেকে। মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ভ্যাপিংয়ে আসক্ত ব্যক্তিরা। তবে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় ই-সিগারেট ব্যবহারের পাশাপাশি আমদানি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন।
Advertisement
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের জাগো নিউজকে বলেন, ই-সিগারেট আগে শুধু রাজধানী বা শহরগুলোতে পাওয়া যেত। এখন সেটা শহর থেকে উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়েও কিছু কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে। এটা যদি ব্যাপক হারে ছড়ায় তাহলে দেশের মানুষ আরও বেশি আসক্তিতে পড়বে। বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়াদের ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। আমরা বলেছি দ্রুত আইন করে ই-সিগারেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা মানস-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. অরুপ রতন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে ই-সিগারেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এ সংখ্যা বেশি। অথচ সিগারেটের মতোই ই-সিগারেটেও ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ই-সিগারেট ব্যবহারে হৃদরোগ ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে। প্রথাগত ধূমপানের চেয়ে এর ক্ষতির মাত্রা কম- এ প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানের সঙ্গে ই-সিগারেটের ব্যবহারের ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি পাঁচগুণ বেশি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূমপান কমাতে ই-সিগারেটকে সহায়ক ঘোষণা দেওয়ার পরিবর্তে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
ই-সিগারেটে যত ক্ষতিস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শিশু ও মাতৃমৃত্যু এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগজনিত মৃত্যু কমেছে। কিন্তু হৃদরোগ-ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ বর্তমানে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশের কারণ এসব অসংক্রামক রোগ। এই রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল বলে এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অতিরিক্ত বোঝা। জাতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকিরও কারণ।
Advertisement
উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের জন্য ধূমপান এবং তামাকের ব্যবহার অন্যতম প্রধান ঝুঁকির কারণ। ই-সিগারেট এমনই একটি নতুন প্রজন্মের তামাকজাত পণ্য। ব্যাটারিচালিত এ যন্ত্রের মাধ্যমে আরও কিছু কেমিক্যালসহ তামাকের নির্যাস বা নিকোটিনকে বাষ্পীভূত করে নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়। নিকোটিন ছাড়া এতে সরাসরি ব্যবহৃত কেমিক্যালের মধ্যে থাকে প্রোপাইলিন গ্লাইকল, গ্লিসারল ও বিভিন্ন ফ্লেভার।
নিকোটিন একটি উচ্চমাত্রার আসক্তিকর কেমিক্যাল এবং এর ব্যবহারে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী নারী ও শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে নিকোটিনের ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। ই-সিগারেটে ব্যবহৃত কেমিক্যাল দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসতন্ত্রে ঝুঁকির কারণ। এছাড়াও ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরল বাষ্পীভূত করার ফলে ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়, যা ক্যানসারের কারণ। গবেষণায় ই-সিগারেটের বাষ্পে সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়ামসহ অন্যান্য ভারী ধাতুর উপস্থিতিও প্রমাণিত হয়েছে, যা ক্যানসারসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।
ই-সিগারেটের ক্ষতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন জাগো নিউজকে বলেন, সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেট আরও বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করি। সিগারেটের নিকোটিন ই-সিগারেটের মতো সরাসরি নিচে নামে না। ফলে এটার ক্ষতি আরও বেশি। এতে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
‘ই-সিগারেট সিগারেটের আসক্তি থেকে দূরে রাখতে ব্যবহার করা হয়- কথাটি ঠিক নয়। বরং তরুণ প্রজন্ম ই-সিগারেট ব্যবহারের মাধ্যমে তামাকের প্রতি বেশি আসক্ত থাকে। ই-সিগারেটে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি সিগারেটের চেয়ে বেশি। যেহেতু এটা ক্ষতিকর তাই আমাদের দেশে এটা নিষিদ্ধ করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে।’
জানা যায়, দেশে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটি সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। ২০১৯ সালে ভারতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ হলে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নতুন করে আইনটি আবার সংশোধন করার কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে খসড়া আইন। নতুন প্রস্তাবিত আইনে যে ছয়টি প্রস্তাবনার খসড়া মন্ত্রণালয়ে পেশ হয়েছে তার মধ্যে ই-সিগারেট বাজারজাত বন্ধ করার বিষয়ে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিং এবং হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রি ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এই পদক্ষেপ নেওয়া গেলে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে। পাশের দেশ ভারত এরই মধ্যে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩২টি দেশে এসব পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ।
আরএসএম/এএসএ/জেআইএম