আন্তর্জাতিক

২০২৩ সালেও ধীরগতিতে চলবে নাইজেরিয়ার অর্থনীতি

আফ্রিকা মহাদেশে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত দেশগুলোর সমন্বয় সাব-সাহারান আফ্রিকা। সাব-সাহারান আফ্রিকার ভাগ্য নাইজেরিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা নাইজেরিয়াকে ধরা হয় আফ্রিকার অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে। আফ্রিকা মহাদেশের প্রতি ৬ জনের ১ জন নাইজেরিয়ান এবং এই মহাদেশের বৃহত্তম অর্থনীতির ও জনবহুল একটি দেশ নাইজেরিয়া।

Advertisement

নাইজেরিয়ায় একটি উন্নয়নশীল মিশ্র অর্থনীতি ব্যবস্থা বিদ্যমান। দেশটির অর্থনীতি মূলত খনিজ তেল (পেট্রোলিয়াম) উৎপাদন ও কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির নাইজেরিয়া তার প্রতিবেশীদের কাছে টানতে সাহায্য করে, একজন হোঁচট খেলে অন্যজন যেমন টেনে নিয়ে যায় সেকরম। দেশটির অর্থনীতিতে যেকোনো সংকট গোটা আফ্রিকার অর্থনীতিতেই তোলপাড় করে দিতে পারে। এরই মধ্যে মহাদেশটির বিভিন্ন দেশে তা দৃশ্যমানও হয়েছে। ঘানা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বৃহৎ দেশগুলোর প্রায় সবই এখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটি বড় সমস্যা হলো ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতি এতো ধীরগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে যে বলাই বাহুল্য। নানা অনিয়মের কারণে প্রকৃত অর্থে আরও দরিদ্র হয়ে উঠেছে দেশটি।

২০১৫ সাল থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সংকটের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও ভুল পদক্ষেপে বিধ্বস্ত হয়েছে দেশটির অর্থনীতি। বলা চলে, নিজেদের কারণেই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দেশটির। স্থানীয় উৎপাদকদের কল্যাণে পাচারকারীদের দৌরাত্ব্য ঠেকাতে ২০১৯ সালে দেশটির সরকার স্থল সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। কয়েক ডজন পণ্য আমদানিতে বিদেশি মুদ্রা নিষিদ্ধ করে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ডলারে লেনদেন সীমিত করে বিনিময় হার বাড়ানোর প্রচেষ্টা ব্যবসার জন্য মৌলিক জিনিসপত্র আমদানি করা কঠিন করে তোলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার মুদ্রা নাইরার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়। এরপর এলো করোনা মহামারি।

অন্ধকারের মাঝেই আলোক ছটা আছে। মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও জ্বালানি তেলের দামের কারণে ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে নাইজেরিয়ার। বাণিজ্যিক রাজধানী লাগোসে স্টার্টআপগুলোর ভিড় বাড়ছে (স্টার্টআপ হচ্ছে নতুন কিংবা ছোট প্রতিষ্ঠান যেটি কাস্টমারদের জন্য ইউনিক কিছু প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিস নিয়ে আসে)। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে নাইজেরিয়ান স্টার্টআপ ২০২১ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।

Advertisement

হলিউডের ন্যায় নলিউড বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র শিল্প তাদের। বার্না বয় থেকে উইজকিড পর্যন্ত নাইজেরিয়ান মিউজিশিয়ানরা বিশ্বজুড়ে পরিচিত।

তবুও লাগোসের সঙ্গে ২২ কোটি মানুষকে খুব একটা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারেনি দেশটির সরকার। বড় ধরনের গর্জনের জন্য বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী মুহাম্মাদু বুহারি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। তবুও তৃতীয় পক্ষের প্রার্থী পিটার ওবির জন্য একটি আকস্মিক জয় ব্যতীত, বিজয়ী ক্লেপ্টোক্র্যাটিক অভিজাতরা একই চক্রে আসবে ক্ষমতায়। থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের ম্যাথিউ পেজ সতর্ক করেন, উভয় প্রধান দলই একই রকম ‘পরিসংখ্যানবাদী, সুরক্ষাবাদী, প্রায়শই আত্ম-পরাজিত নীতি’ অনুসরণ করে।

নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তা দেশটির প্রবৃদ্ধিকে আরও বেশি বাধাগ্রস্ত করেছে। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে, ৬ হাজার নাইজেরিয়ান সংঘর্ষে নিহত হয়। উত্তর-পূর্বের পশ্চিম আফ্রিকা প্রদেশ থেকে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী রাজধানী আবুজার দিকে অগ্রসর হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমে মিলিশিয়ারা নিয়মিত চাঁদাবাজি ও অপহরণের জন্য বেসামরিক লোকদের টার্গেট করে।

এ ছাড়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাধা আরও অন্যান্য বিষয় আছে। গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ২১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দেশটিতে। এটি কমাতে উচ্চ সুদের হার প্রয়োজন হবে। সরকার কম ট্যাক্স সংগ্রহ করার কারণে ঋণ সেবা করা একটি উদ্বেগজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে সেটিও কাজে আসছে না। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে, কিন্তু অতিরিক্ত তেলের দাম জনসাধারণের জন্য সাপেবর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

অর্থমন্ত্রী জয়নাব আহমেদ বলেছেন নাইজেরিয়া, সাধারণত আফ্রিকার বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী, যা জ্বালানিতে ভর্তুকি দেয়। কিন্তু তা করার খরচ তেলের উচ্চ মূল্য থেকে অতিরিক্ত রাজস্বের চেয়ে বেশি। তাই নেট প্রভাব ‘শূন্য বা নেতিবাচক’। ব্যাপক চুরি-জালিয়াতির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

এসব ঘটনাই একদিন সরকারকে ভর্তুকি ত্যাগ করতে প্ররোচিত করবে। অবকাঠামো ও শিক্ষার মতো খাতে আরও ভালো সুযোগসহ ব্যয় করার জন্য অর্থ মুক্ত করবে সরকার। দীর্ঘমেয়াদে তেলের ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব নাইজেরিয়াকে তার বর্তমান মডেল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে, যেখানে অভিজাতরা তাদের নাগরিকদের উপেক্ষা করে তেলের অর্থ নিয়ে মারামারিও করে। বলা চলে, ২০২৩ সালে মন্থর গতিতেই চলবে নাইজেরিয়ার অর্থনীতির চাকা।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএনআর/জেআইএম