দেশজুড়ে

হাসপাতালে অনিয়মিত চিকিৎসক, আবাসিক ভবন যেন ভুতুড়ে বাড়ি

কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ২০ শয্যা বিশিষ্ট গোহারুয়া হাসপাতালটি ১৬ বছরেও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি। এতে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাঁচ উপজেলার চার লাখেরও বেশি মানুষ।

Advertisement

বর্তমানে তিন চিকিৎসক ও তিন নার্সের নিয়োগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হাসপাতালে না গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সময় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাঝে মধ্যে সেবা দিতে এলেও ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যান তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

তবে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, নিরাপত্তাজনিত কারণেই চিকিৎসকরা সেখানে অবস্থান করেন না। তবে চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখেছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, ২০০৪ সালের ১৫ এপ্রিল হাসপাতালটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। ২০০৬ সালের ১৭ অক্টোবর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান এই হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। হাসপাতাল ভবন ছাড়াও আরও তিনটি দ্বিতল ভবন ও দুটি একতলা ভবন স্থাপন করা হয় চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের জন্য। এতে মোট ব্যয় হয় ৬ কোটি টাকা। কিন্তু কোনো চিকিৎসক পদায়ন না করে উদ্বোধন করায় শুরুতেই হোঁচট খায় হাসপাতালটি।

Advertisement

এলাকাবাসীর দাবিতে ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য সচিবের কাছে হাসপাতালটি চালু ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিবের কাছে চিঠি দেন কুমিল্লার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান।

ওই বছরই হাসপাতালটির জন্য ছয়জন ডাক্তার ও ছয়জন নার্সের মোট ১২টি পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু জুন মাসে নিয়োগ দেওয়া হয় মাত্র একজন চিকিৎসা কর্মকর্তাকে। ওই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি এ হাসপাতালে ছিলেন কাগজে কলমে। তিনি যাওয়ার পর দুই নারী চিকিৎসক, একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও গাইনি বিশেষজ্ঞ কিছুদিন দায়িত্ব পান। তাদের কেউ বাস্তবে আসেননি।

২০১৫ সালের নভেম্বরে ঢাকায় প্রেষণে চলে যান গাইনি চিকিৎসক। চিকিৎসা কর্মকর্তা সপ্তাহে দুদিন এই হাসপাতালে ও চারদিন নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করেন। কিছুদিন পর তিনিও বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। এরই মধ্যে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে হাসপাতালটি।

এদিকে ২০১৬ সালে কাগজে কলমে দুজন নার্স পদায়ন করা হয়, কিন্তু ডাক্তার না থাকায় বন্ধ থাকে হাসপাতাল। তারাও কখনো আসেননি কর্মস্থলে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী (বর্তমান অর্থমন্ত্রী) মুস্তাফা কামাল, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন। তারা পুনরায় হাসপাতালটি পুরোদমে চালুর আশ্বাস প্রদান করেন। এরপর জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়।

Advertisement

ওই বছরই ১৩টি পদ সৃষ্টি করা হয়। যেখানে মোট ১৮ জন নিয়োগ পাওয়ার কথা। এরপরও আলোর মুখ দেখেনি হাসপাতালটি। ২০১৯ সালে এক চিকিৎসা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এ হাসপাতালে। একা হওয়ায় তিনিও অন্যত্র বদলি হন।

২০২০ সালের জুন মাসে তিনজন ডাক্তার, তিনজন নার্স, একজন ওয়ার্ডবয় ও একজন অফিস সহকারীকে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে সেখানে আউটডোরে সেবা দিচ্ছেন মাত্র একজন। তবে ইনডোর সেবা দেওয়ার জন্য এখনো কোনো শয্যা স্থাপন করা হয়নি হাসপাতালটিতে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সামনে গরু বেঁধে রেখেছেন স্থানীয়রা। হাসপাতাল ব্যতীত বাকি ভবনগুলো স্থানীয়দের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে গবাদি পশুর খাবার ও লাকড়ি রাখা হয়েছে। চারদিকে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। সবগুলো ভবন ঝোপ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। যেন ভুতুড়ে পরিবেশ। বৈদ্যুতিক সুইচ-মিটারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। হাসপাতালের ভবনের প্রধান ফটকে নেই তালা। কেঁচি গেট ভেঙে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ভবনটিও। নষ্ট হয়ে গেছে ভেতরের আসবাবপত্র।

হাসপাতালের নিচ তলার একটি মাত্র কক্ষে দেওয়া হচ্ছে নামমাত্র চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালের মুল ভবনসহ অন্য স্থাপনাগুলোতে দিন রাত চলে মদ, জুয়ার আসর ও বখাটেদের আড্ডা। এ যেন নিরাপদ আস্তানা হিসেবে গড়ে উঠেছে হাসপাতালের আঙ্গিনা।

হাসপাতালটিতে বর্তমানে এক আবাসিক চিকিৎসক, মেডিকেল কর্মকর্তা ও গাইনি বিশেষজ্ঞ, তিন নার্স, এক ওয়ার্ডবয় এবং একজন অফিস সহকারী থাকলেও সরেজমিনে গিয়ে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বহির্বিভাগে সবসময় ডাক্তাররা আসেন না। মাঝেমধ্যে একজন ডাক্তার আসেন। তাও আবার ঘণ্টাখানেক রোগী দেখে চলে যান। হাসপাতালটিতে নেই কোনো ওষুধ বরাদ্দও। এক কথায় বলা চলে এটি মানুষের কোনো উপকারেই আসছে না। শুধু শুধু সরকারের টাকা নষ্ট ছাড়া আর কিছুই না।

স্থানীয় বাসিন্দা শরিফুল হক ভূঁইয়া বলেন, সন্ধ্যার পর এখানে মাদকের আড্ডা শুরু হয়। এছাড়া যারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারাও এখানে এসে আড্ডা দেন।

তিনি আরও জানান, পূর্ণাঙ্গভাবে হাসপাতালটি চালু হলে এখানকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হতো। কষ্ট করে দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না।

এ বিষয়ে তৎকালীন নাঙ্গলকোট আসনের সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘গোহারুয়া ২০শয্যা হাসপাতাল ভুতের বাড়ি ও গরু ছাগলের আড্ডাখানা! বিএনপি করেছিল বলেই আজ এটির এ বেহাল দশা। রাজনীতির প্রতিহিংসায় শিকার হয়েছে হাসপাতালটি। পুরোদমে চালুর আহ্বান জানাচ্ছি।

জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গোহারুয়ার বাসিন্দা মাসুদ রানা ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এলাকাবাসীর দাবিতে পুনরায় এটি চালু হয়। দুই মাসপর অজ্ঞাত কারণে আবারও ঝিমিয়ে পড়ে। এখন মাঝেমধ্যে একজন ডাক্তার আসেন। তিনি ঘণ্টাদুয়েক রোগী দেখে চলে যান। বর্তমানে এ হাসপাতালটি অরক্ষিত হিসেবে পড়ে আছে। এটি পুরোদমে চালু হলে নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, লাকসাম, নোয়াখালীর সেনবাগ ও সোনাইমুড়ির একাংশের প্রায় ৫ লাখ মানুষ চিকিৎসা সেবা পেতো।

নাঙ্গলকোট উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা দেবদাস দেব জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছি ওই এলাকার মানুষদের সেবা দেওয়ার জন্য। নিরাপত্তাজনিত কারণে পদায়নকৃত ডাক্তাররা সেখানে যেতে চান না। হাসপাতাল আঙ্গিনায় চলে জুয়ার আসর ও বখাটেদের আড্ডা। সীমানা প্রাচীর নির্মাণ সময়ের দাবি।

কুমিল্লা ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ চালুর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, সরঞ্জাম এবং অর্থ বরাদ্দসহ সব চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বহির্বিভাগে স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্বে যারা আছেন তারা সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা সেটি ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ অবহেলা করলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসজে/জেআইএম