কাজী হানিয়াম মারিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তার জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের নানা বাড়িতে। তিনি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেছেন। জাপানের শিজুয়োকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যানোটেকনোলজির ওপর পিএইচডি করেছেন।
Advertisement
তার শিক্ষকতা ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক জাহিদ হাসান—
জাগো নিউজ: আপনার ছেলেবেলা এবং বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই—কাজী হানিয়াম মারিয়া: ছেলেবেলা কিশোরগঞ্জে কেটেছে। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি। আমার আব্বা, দুই চাচা ও দাদির সঙ্গে একই বাড়িতে কেটেছে। শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে চাচাতো, ফুপাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে। একান্নবর্তী পরিবারের টক-ঝাল-মিষ্টি আবহাওয়ায় বড় হয়েছি বলেই আমার মাঝে যে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বেশি।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল? জীবনের অর্জনে কার পরামর্শের প্রভাব বেশি?কাজী হানিয়াম মারিয়া: আমি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল, যেটা এখনো অপরিবর্তিত! তবে পড়াশোনার ব্যাপারে সব সময়ই পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছি। সাধারণত উচ্চমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। কিন্তু প্রফেশন পছন্দের ক্ষেত্রে মেয়েদের ওপর নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়। সেটা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। তবে আমি কিছুটা একরোখা ছিলাম। তাই মান-অভিমান বা জিদ করে হলেও আমার পেশা আমি পছন্দ করেছি।
Advertisement
আমার সব কাজে আম্মা পাশে ছিলেন। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনা খুব ভালো ভাবে করতে পারেননি। কিন্তু নিজের মেয়েদের মাঝে স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন। চাপ দেননি, জোর করে কখনো পড়তে বসাননি। কিন্তু এমনভাবে উৎসাহ দিতেন, আমরা পড়তাম। আমরা ভালো করলে আম্মা-আব্বা অনেক খুশি হতেন। বাসায় পড়াশোনার পরিবেশ ছিল। পড়াশোনার বাইরের বইও আমরা পড়তাম। মনে আছে, ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলি আব্বা-আম্মার সাথে সিরিয়াল দিয়ে পড়তাম। এভাবেই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছেন। তারা চাইতেন, আমরা তিন ভাই-বোনই যেন সব সময় নিজেদের দায়িত্ব নিতে পারি। সেটা করার জন্য পড়াশোনা ছাড়া কোনো গতি নেই।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তৈরি হলো কখন?কাজী হানিয়াম মারিয়া: স্কুল-কলেজ শেষ করার পর তো আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে—আমি এসব শুনেই বড় হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই একুশে বইমেলায় আসতাম। তখন থেকেই আমি মনে করতাম, এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়, বড় হয়ে এখানে পড়বো। ছোটবেলায় তো এতো ভর্তিযুদ্ধ বুঝতাম না। তাই স্বপ্নটা কখন মনে গেঁথে গেছে বলতে পারবো না।
জাগো নিউজ: উচ্চশিক্ষা কোন বিষয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, পদার্থবিজ্ঞান কেন বেছে নিলেন?কাজী হানিয়াম মারিয়া: আমি ৯৮ সালের এসএসসি ব্যাচ। আমাদের সময় সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছিল। সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়টা ভেঙে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান পেয়েছিলাম। বইয়ের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলাম। কীভাবে পড়তে হবে, সে সম্পর্কে শিক্ষক-বড়দেরও তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। হঠাৎ বড় সিলেবাস প্রণয়নের কারণে একটু বেশি পড়তে হয়েছে। কলেজের লাইব্রেরি অনেক সাহায্য করেছে। কোনোকিছু বুঝতে অনেক বইয়ের সাহায্য নিয়েছি। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টি আমাদের কাছে সব সময়ই কঠিনভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেক পড়তে হবে, অনেক কঠিন—এভাবে শুনে এসেছি। কিন্তু কোনো কিছু জানার মধ্যে যে আনন্দ আছে, সেটা বলা হতো না। আমি একটু দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম এবং মনে সারাক্ষণ প্রশ্ন ঘুরতো। পদার্থবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে আমি প্রশ্ন করার এবং উত্তর খুঁজে বের করার পরিপূর্ণ আনন্দ পেয়েছি। তাই ভর্তি পরীক্ষার পর যখন এ সাবজেক্ট পেয়েছি, খুশি হয়েছি এবং বুঝেই পড়ার চেষ্টা করেছি।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন কখন থেকে বুনতে শুরু করলেন? কাজী হানিয়াম মারিয়া: ছোট থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। কারণ আমার পড়তে ভালো লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে থেকেই শিক্ষক হতে চেয়েছি। হয়তো শুনতে খুব অদ্ভুত লাগছে কিন্তু চেয়েছি। আব্বা-আম্মা কখনো চাননি। কিন্তু আমার ভালো লাগাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আমি সেভাবেই নিজেকে তৈরি করেছি। এখনো খুবই চিন্তা করে গুছিয়ে কাজ করি। প্ল্যান ছাড়া কীভাবে কাজ করতে হয়, আমি জানি না। আমার যেটা চাই; সেটার জন্য আমাকে তৈরি করি। প্রথমবার না হলে, আবার করি। আমার ব্যর্থতার দায়ভার কাউকে দিই না। নিজের ভালো লাগার কাজ ভালোভাবে করে বলে বেড়ানোর কারণও খুঁজে পাই না।
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনার প্রথম চাকরি কোনটি। শিক্ষকতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন বেছে নিলেন? কাজী হানিয়াম মারিয়া: একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে চাকরিজীবনে প্রবেশ করি। অনেক কিছু শিখেছি সেখানে। শিক্ষকতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের ডিপার্টমেন্টে জয়েন করা একটা সুন্দর স্বপ্ন পূরণের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এবং পড়ানো ছাড়া আমি অন্য কিছু কেন চিন্তা করিনি, তার কোনো সঠিক জবাব আমার কাছে নেই। আমি শুধু জানি, এর থেকে কোনো ভালো কাজ আমি করতে পারবো না। কারণ আমি আমার স্বপ্নকে প্রতিদিন সত্যি হতে দেখি।
জাগো নিউজ: ক্যারিয়ারে ভালো লাগার মতো স্মরণীয় গল্প শুনতে চাই— কাজী হানিয়াম মারিয়া: আমি কাজকে ভালোবাসি। সেটা ছাত্রদের পড়ানো হোক আর গবেষণা হোক। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সংক্রান্ত যে কোনো কাজে চেষ্টা করি সর্বোচ্চটা দিয়ে সাহায্য করতে। আমি তাদের মোটিভেট করার কোনো মুহূর্তই ছাড়ি না। তাদের স্বপ্নগুলো শুনতেও ভালো লাগে। তাদের স্বপ্নপূরণের এতটুকু সহযোগী হলেও আমি নিজের স্বপ্ন পূরণের মতো আনন্দ পাই। একজন শিক্ষকের এসবই স্মরণীয় হওয়া উচিত। কারণ জব রিকোয়ারমেন্টের জন্য আমরা উচ্চতর ডিগ্রি নিই, মনের আনন্দ এবং জানার জন্য গবেষণা করি। কিন্তু ভুলে যাই শিক্ষার্থীদের জন্যই আমরা শিক্ষক। শিক্ষকতার আনন্দ তাদের সফলতায় খুঁজে পাই। যদিও গবেষণার জন্য পুরস্কার, স্কলারশিপ এবং অনুদান পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো আসলে আমার ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ওগুলোকে স্মরণীয় বলতে পারছি না!
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার এখনকার চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?কাজী হানিয়াম মারিয়া: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন লেয়ার উন্মোচন হচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত আমাদের শিখতে হয়। সময়ের সাথে সাথে নিজেরা আপডেটেড না থাকলে তো আমরা শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারবো না।
জাগো নিউজ: তরুণদের কেন পদার্থবিজ্ঞান পড়া উচিত?কাজী হানিয়াম মারিয়া: পদার্থবিজ্ঞান একটি মৌলিক বিষয়। বিষয়টি অধ্যয়নের জন্য প্রচুর ধৈর্য এবং পরিশ্রম করতে হয়। শর্টকাটে বা সাজেশনের সাহায্য নিয়ে এ বিষয়ে পাস করা গেলেও ভালো করা যায় না। শুধু পরিশ্রমী এবং জানার আগ্রহীদেরই এ বিষয়ে পড়া উচিত। বিজ্ঞান গবেষণায় আগ্রহীদের জন্য পদার্থবিজ্ঞান চমৎকার একটি বিষয়।
আসলে আমাদের দেশের ছাত্ররা নিজের ইচ্ছেমতো বিষয়ে পড়তে পারে না। ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে খুব কমই নিজের ইচ্ছায় এ সাবজেক্ট পড়তে আসে। ভবিষ্যৎ চাকরির কথা চিন্তা করে অভিভাবকরাও বাচ্চাদের উৎসাহ দেন না এ বিষয় পড়ার। প্রতিবছর প্রথমবর্ষের ক্লাসে একঝাঁক বিমর্ষ মুখ দেখতে খারাপ লাগে। অনেক ছাত্র আবার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আমরা তখন সম্ভাবনার কথা বলে পড়ালেখায় ওদের মন ফেরাতে চেষ্টা করি। কিন্তু বিষয় পছন্দের নয় বলে অনেকেই শুধু ডিগ্রির জন্যই পড়ে যান।
কেন যেন সবাই মনে করেন, পদার্থবিজ্ঞান পড়া মানেই শিক্ষকতা করতে হবে! আসলে তা নয়। বিষয়টি পড়ে ভালো গবেষক হতে পারেন। দেশে এখন গবেষণার অনেক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। তার জন্য আপনাকে পরিশ্রমী হতে হবে। ভালো সবকিছুর জন্যই পরিশ্রম করতে হয়। কঠোর পরিশ্রমই মানুষকে মেধাবী করে তোলে।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কি শুধু চাকরি, নাকি বৈচিত্র্যময় দায়িত্ব?কাজী হানিয়াম মারিয়া: স্কুল-কলেজে শিক্ষকতার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা বেশ ভিন্ন। কারণ আমরা ক্লাসে পরিপূর্ণ একজন মানুষ পাই। কবি সুকান্তের আঠারো বছর বয়সের বর্ণনার মতোই শিক্ষার্থীরা। তাই তাদের মধ্যে স্বপ্ন বোনা ব্যাপারটা বেশ কষ্টকর। আমাদের দেশে ওই আঠারো বছর বয়সে ওদের উপর পারিবারিক চাপসহ আর্থিক-সামাজিক অনেক চাপ থাকে। পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পেরে হঠাৎ পরিবার ছেড়ে এবং পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে একপ্রকার মানসিক চাপ সামলাতে হয় তাদের। সাথে হলের রাজনৈতিক বড় ভাইদের সামলিয়ে প্রথম বর্ষে এই ছাত্ররা বেশ বিপর্যস্ত থাকে। এসময় তাদের মান-অপমানবোধও তীক্ষ হতে শুরু করে। জীবন গড়ার মুহূর্তেই এত চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই অভিমান করে শিক্ষকদের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেন। তাই কী করা উচিত, তা অনেক যত্ন করে তাদের বোঝাতে হয়। আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটু দায়িত্ব নিয়ে তাদের গাইড করা উচিত। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা কখনোই কোনো চাকরি নয়। এটা একটা দায়িত্ববোধ। কারণ শিক্ষকরা সরাসরি সমাজের তরুণদের সাথে সংযুক্ত। এই সময়টাতে শিক্ষকরা চাইলে পারেন তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের বোধটুকু গেঁথে দিতে। বর্তমানে শিক্ষকদের ইমেজ সংকটের কারণে হয়তো অনেকে মানতে চাইবেন না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সমাজ পরিবর্তন এবং গড়তে শিক্ষকরা রোল মডেল হিসেবে কাজ করেন। আমি আমার অনেক কাজের প্রেরণা আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছি।
জাগো নিউজ: যারা বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষক হতে চান; তাদের জন্য আপনার পরামর্শ— কাজী হানিয়াম মারিয়া: বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতার জন্য অবশ্যই প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। ছাত্রদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। নয়তো বিষয়কে ইন্টারেস্টিং করে তুলে ধরা যায় না।নতুন নতুন পড়ানোর আইডিয়া, প্রশ্নের ধরন তৈরির মানসিকতা থাকতে হবে। গতানুগতিক পরীক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানের প্রতি ছাত্রদের ভালোবাসা তৈরি করা যাবে না। নতুন নতুন কী গবেষণা হচ্ছে; সে বিষয়ে আপডেটেড থাকতে হবে। গল্পের ছলে তাদের মাঝে বিষয় সম্পর্কে আগ্রহ গড়ে তুলতে হবে।
আমি এখানে একটা বিষয় যুক্ত করতে চাই, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা করার কথা বলতে বলতে আজকাল ক্লাসের পারফরমেন্সকে বিবেচনায় নিই না। ক্লাসে অবশ্যই তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত। অনার্স লেভেলের ছাত্রদের ভালো পড়ানোর মাধ্যমেই আমরা ভালো গবেষক তৈরি করতে পারি। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান যখন খুব ভালো থাকবে; তখন খুব ভালো ক্লাস নেওয়া যায়। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয় যখন একদল ছাত্র মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে, প্রশ্ন করে; তখন সেই দৃশ্য শিল্পীর ছবি আঁকার মতই সুন্দর।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয় ইস্যুতে কেন নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন? কাজী হানিয়াম মারিয়া: নেতৃত্ব কোনো সহজাত গুণ নয়। সৎ এবং বিবেচক মানুষের মধ্যেই শুধু গুণটি থাকে। নেতা সাধারণত জনগণকে প্রভাবিত করে, নিজে ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবান্বিত হন না। জাতীয় ইস্যুতে শিক্ষকরা নিজস্ব সুচিন্তিত মতামতের চেয়ে ক্ষমতাঘেঁষা মতামত প্রদান করছেন। জনগণের ভালো-মন্দ বিবেচনা করছেন না। পদ-পদবি পেতে ক্ষমতাসীনদের সুনজরে থাকার লোভে তারা সঠিক চিন্তা করছেন না বলেই নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়ছেন। শিক্ষক নেতার মতো কথা বললে সেটা বরাবরই শ্রুতিকটু হয়। শিক্ষককে নিরপেক্ষভাবে ন্যায়ের পক্ষেই কথা বলা উচিত। ভয় পেয়ে যদি শিক্ষক কথা না বলেন, তাও মানা যায় কিন্তু শিক্ষকের মুখে নেতার মতো প্রলাপ শুনতে জনগণ একদমই পছন্দ করেন না। তাই নেতৃত্বে পিছিয়ে যাচ্ছেন।
জাগো নিউজ: প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে আমরা কতটুকু সঠিক পথে আছি?কাজী হানিয়াম মারিয়া: দুঃখের সাথে বলছি, আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা ডিজিটাল ব্যাপারটাই বুঝতে পারছি না। কিছু মোবাইল অ্যাপস তৈরি করলেই ডিজিটালাইজেশন হয় না। এখনো সরকারি অফিসগুলোয় লাইন ধরে অপেক্ষা করতে হয়। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেজিস্টার ভবনই ডিজিটাল না।
আমাদের একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশন নেই। আমাদের দেশে গবেষণা পাবলিশ হলেও প্রয়োগ হচ্ছে না। এখানেই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। বাইরে যারা ভালো গবেষণা করেন, তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নেওয়া হলে আমাদের ছাত্ররা অনেক কিছু শিখতে পারবে। গবেষণার ক্ষেত্রে যে অনুদান আমরা পাই, তা খুবই অপ্রতুল। লাখ টাকার প্রজেক্ট লিখে হাজার টাকা পেয়ে সেটার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে দেখা যায়, গবেষককে আরেক দফা গবেষণা করতে হয়। ফলে অনেকেই ল্যাবের যন্ত্রপাতি নির্ভর কাজ করার চেয়ে তাত্ত্বিক বিষয়ে গবেষণায় ঝুঁকে পড়ছেন। তারপরও বলবো, অনেকে বেশ ভালো গবেষণা করছেন। তাই গবেষণা অনুদান সবার মাঝে ভাগাভাগি না করে প্রজেক্টের মেধার ভিত্তিতে দেওয়া উচিত। আমরা শুধু নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিতে মনোযোগী। কিন্তু পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো যে অনুন্নত; সে বিষয়টা খেয়াল করছি না। এই ল্যাবগুলো উন্নত করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। হাজার হাজার ছাত্রের জন্য একটি যন্ত্র রাখলে সেটা তো নষ্ট হবেই!
জাগো নিউজ: সম্প্রতি ইউনেস্কোর একটি প্রকল্পে আর্জেন্টিনাসহ লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা শুনতে চাই— কাজী হানিয়াম মারিয়া: আমি অনেক নতুন বিষয় শিখেছি। জীবন সম্পর্কেও আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। দুনিয়ার অন্যপ্রান্তেও আমাদের মতো সমস্যায় জর্জরিত মানুষ বসবাস করে কিন্তু তারা তাদের সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তারা সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছেন। আমি সেই চেষ্টার ছোট্ট একটা অংশ নিয়ে কাজ করেছি। আশা করছি ছাত্রদের মাঝে সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারবো।
জাগো নিউজ: দেশ নিয়ে কোন স্বপ্নটা বেশি দেখেন? কোন বিষয়গুলো পাল্টে দিতে খুব ইচ্ছে হয়?কাজী হানিয়াম মারিয়া: আমি স্বপ্নবাজ। দেশ নিয়ে আমার একটা নয়, অনেক স্বপ্ন। যে বিষয়গুলো পাল্টে দিতে চাই তার সবগুলোর মূলেই আছে দুর্নীতি। সেই দুর্নীতি দূর হলেই দেশে সমস্যা থাকবে না। কিন্তু এটা তো অনেক বড় ব্যাপার। তাই আমি আমার সেক্টরের মানে শিক্ষাব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন করতে চাই। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় না করে এক্সিটিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উন্নত ল্যাব তৈরি হোক। আমাদের ছাত্ররা দেশে ভালো মানের ল্যাব ফেসিলিটি পাক, বাইরে থেকে ভালো গবেষকরা এসে তাদের প্রশিক্ষণ দিক। দেশের টাকায় কাউকে বাইরে ডিগ্রি নিতে না পাঠিয়ে বরং ভালো ল্যাব তৈরি হোক। তবে দেশ নিয়ে আমি সব সময় আশাবাদী। কারণ জনগণের বেশিরভাগই তরুণ। এই তারুণ্যকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এসইউ/এমএস