আজ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন, এটা নিতান্তই গতানুগতিক ব্যাপার। কিন্তু বিষয়টি যখন গণতন্ত্র ও দলীয় রাজনীতি তখন এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চাই শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের পথ সুগম করে। সেই চর্চা বাংলাদেশে কতটা হয় সে নিয়ে বড় বিতর্ক থাকলেও, আওয়ামী লীগ নিয়মিত সম্মেলন করছে, এটা এক বড় দৃষ্টান্ত।
Advertisement
রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই ২২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলে সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি থাকছেন, সেটি নিশ্চিত। তবে কতে হবে সাধারণ সম্পাদক, অর্থাৎ দুই নম্বর পজিশন নিয়েই চলছে এক নম্বর আলোচনা। একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে ঠিকই, তবে ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের উদাহরণ খুব কম। বরাবরই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্বাচন হয় আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে। এবারও আলোচনার মাধ্যমেই নেতৃত্ব নির্বাচন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এটি নিয়ম রক্ষার সম্মেলন। তাই বড় ধরনের পরিবর্তন বা চমক হয়তো দেখা যাবে না, এমনটাই বলা হচ্ছে দলের ভেতর ও বাইরে থেকে। তবে নির্বাচনী বছরে এই সম্মেলন আয়োজন দলের কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সঞ্চার করেছে। নির্বাচনের আগে এই সম্মেলন দলকে চাঙা করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক। ২৩ জুন ১৯৪৯ দলটি যাত্রা শুরু করেছিলে ঢাকার রোজ গার্ডেন হোটেলে সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে। প্রচুর ঘাতপ্রতিঘাত পেরোতে হয়েছে দলকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দলটি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে দিয়েছে তাদের নিজস্ব ভূখণ্ড বাংলাদেশ। তাই আওয়ামী লীগের সম্মেলন মানেই ইতিহাসের স্মরণ। ৭৩ বছর বয়সী রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতার আছে টানা তৃতীয়বারের মতো। তবে দলটির বড় সময় কেটেছে লড়াই-সংগ্রামে, গণমানুষের অধিকার আদায়ে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবার হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। সে দিন দেশে না থাকাতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনার উপরেও হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা হয়েছে ২০ বারের বেশি। আমরা দেখেছি ২১ অগস্টের মতো পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা।
Advertisement
ক্ষমতায় আসার আগে এবং পরে সম্মেলন কজরার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। মনে থাকবার কথা ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল দলটির নবম সম্মেলন। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের দশম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতে এএইচএম কামরুজ্জামান সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। ৩ নভেম্বর জেলখানায় আরও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর গভীর সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৭ সালের ৩-৪ এপ্রিল হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে দলের ১১তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে সম্মেলন করছে। আগামীতে নির্বাচন। অনেক বাস্তবতা মাথায় নিয়ে এবারের সম্মেলন হচ্ছে। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকদিন ধরে আওয়ামী লীগ নিজের কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে। খোদ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজের সংসদীয় এলাকায়ও আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মানুষ মারা যেতে দেখেছি। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক জেলা উপজেলায় এবং বিভাগে শাসক দলের ভেতর বিবাদ এবং বিবাদকে কেন্দ্র করে সহিংসতা দেখে আসছে মানুষ। সারাদেশেই এখন আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। কলহ-কোন্দল সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে খবর থাকছে। বিরোধী দল দুর্বল, তাই দলের ভেতর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যেই বিবাদে জড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা। বাংলাদেশের রাজনীতির সুনাম হলো সহিংসতা। এক দলের প্রতিপক্ষ আরেক দলের লড়াই, সংঘর্ষ স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এক দলের ভেতর যখন অনেক দল গড়ে ওঠে তখন পরিস্থিতি বেশি উত্তপ্ত হয়।
ব্যাপক জনভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সবসময়ই তার সাংগঠনিক কাঠামোর উপরে নির্ভরশীল। এর ভিত্তি এত শক্তিশালি যে, একেবারে তৃণমূল পর্যায়েও রয়েছে দলটি শাখা কমিটি। এসব শাখা হয়তো গুরুতর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে মাথা ঘামায় না। তবে পাড়ায় পাড়ায়, ছোট ছোট এলাকা ভিত্তিতে তারাই দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের প্রাথমিক সেতু। যেকোন বিষয়ে যেকোন এলাকায় সাধারণ মানুষ কী ভাবছেন, তার আভাস শাখা স্তর থেকেই দলের উপরের তলায় পৌঁছায়। কেন্দ্রীয় সম্মেলন যখন হয়, তখন নিশ্চয়ই শাখা স্তর থেকে আসা বার্তা বিবেচনায় নিয়েই। দলের নেতৃত্বে আছেন শেখ হাসিনা। তবে কেন্দ্রীয় অন্যান্য নেতাসহ, শাখা ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সচেতনতা, সক্রিয়তাই পারে এসব কোন্দল থামাতে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দলের ভেতর সংহতির শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে দল, উপদল। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নেতা ও তাদের গোষ্ঠী। এর সুযোগ নিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা যতটা ক্ষমতার চর্চা করছে, ততটা করছে না রাজনৈতিক চর্চা। এবারের সম্মেলনে যারাই যে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন তারা আশা করি মনে রাখবেন যে, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক উপকরণ যাদের রাজনীতির পুঁজি তাদের হাত শক্তিশালী হয় শাসক দলের কোন্দল আর সহিংসতায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
Advertisement
এইচআর/এমএস