২০০৩ সালে ২০ লাখ টাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পাঁচ কাঠা জমি বরাদ্দ নিয়েছিলেন মমিনুল ইসলাম (ছদ্ম নাম)। সপরিবারে ভাড়া বাসায় থাকেন মিরপুর পল্লবী এলাকায়। বয়স এখন ৭০। নিজের জমিতে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। রাজউকের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে মমিনুল জাগো নিউজকে বলেন, ৫০ বছর বয়সে ২০ লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ কাঠার প্লট কিনেছিলাম। অথচ ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও জমিতে বাড়ি নির্মাণ করে শেষ জীবন কাটাবো তার কোনো ভরসা পাচ্ছি না। বসবাস করার মতো কোননো অবকাঠামোগত সুবিধাও নেই। আমি মনে করি রাজউকের উদাসীনতার কারণেই এ অবস্থা।
Advertisement
সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উত্তরা তৃতীয় পর্ব আবাসনে শুধু ১৮ নম্বর সেক্টরের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি সেক্টরগুলো অন্ধকারে। যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন মেট্রোরেল ঘিরে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন প্রত্যাশা।
উত্তরা তৃতীয় পর্বে একটি সেক্টরে ফুটেছে আলো
যান্ত্রিকতার ফাঁদে ক্রমেই আটকে পড়ছে ঢাকাবাসীর জীবন। হাঁপিয়ে ওঠা নগরজীবনে নেই সবুজের ছোঁয়া কিংবা নির্মল প্রকৃতি। এখানে বাতাসেও যেন বিষ। ইট-পাথরের ঘেরাটোপে নেই বুকভরা নিশ্বাস। তীব্র যানজট, ধুলোবালি, উচ্চ শব্দদূষণ আর মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্ব যেন এ শহরের অভিশাপ। তারপরও সব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে এখানে জীবন ছুটে চলে প্রাত্যহিক নিয়মে। একই ধারায় চিরচেনা রূপে।
Advertisement
অথচ নগরী থেকে খানিক দূরে চোখ ফেরালেই চোখে পড়ে সবুজ আর স্বস্তির অন্য এক ভূখণ্ড। সেগুলোরই একটি রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকা। যেখানে নাগরিক জীবনে একদণ্ড শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে সবুজ বনানী। আছে শুভ্র কাশফুল, লেকের টলমলে জল, খোলা আকাশ আর বিশুদ্ধ বাতাস। একটু সুযোগ পেলেই ঢাকার মানুষ যেন আশপাশের এরকম স্থানগুলোতে ছুটে যেতে যান। পেতে চান প্রকৃতির সান্নিধ্য। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যারা কাজে কিংবা ঘুরতে ঢাকায় আসেন তারাও দুদণ্ড শান্তি খোঁজেন দিয়াবাড়ীর উন্মুক্ত আকাশের নিচে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একসময় বিভিন্ন অপরাধীচক্রের দৌরাত্ম্যও ছিল দিয়াবাড়ীতে। ‘কিশোর গ্যাং’, ‘ফিটিং পার্টি’সহ বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে নাজেহাল হওয়া, ছিনতাই বা ব্ল্যাকমেইলের কারণে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন খোয়ানো, মারধরের শিকার হওয়ার মতো ঘটনা ছিল সেখানকার নিত্যদিনের চিত্র। সেই দিয়াবাড়ীতেই উত্তরা তৃতীয় পর্বে গড়ে উঠেছে ‘রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প’। প্রকল্পের ব্যয় ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা। গড়ে উঠেছে ছয় হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট।
কিন্তু অপরাধীচক্রের অভয়ারণ্য ও যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় এখনো ৭০ শতাংশ ফ্ল্যাট পড়ে আছে খালি। বাকি ৩০ শতাংশ ফ্ল্যাটে মানুষ বসবাস করছে। সেখানকার বাসিন্দা ও ফ্ল্যাট মালিকেরা এখন স্বপ্নের মেট্রোরেলে ভর করে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। কারণ, মেট্রোরেল উত্তরা মধ্য স্টেশন থেকে হেঁটে এ প্রকল্পে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। আরও পড়ুন: যেভাবে ভ্রমণ করা যাবে ঢাকার মেট্রোরেলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াছিন আলী। বর্তমানে রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের কর্ণফুলী ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ২০১৮ সাল থেকে বসবাস করেন। এক সময় সেখান থেকে নিয়মিত মতিঝিলে অফিস করতেন। আবাসন থেকে আগারগাঁও এলাকা যেতেই কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো।
Advertisement
ইয়াছিন আলী জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেল আমাদের একমাত্র ভরসা। মেট্রোরেল না হলে এখান থেকে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। যে কারণে ৭০ শতাংশ ফ্ল্যাট এখনো ফাঁকা। কারণ, সন্ধ্যা হলেই এই এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ নেমে আসে। ছিনতাই ও চুরি প্রতিদিনের ঘটনা। এক সময় আমরা সন্ধ্যার পর বাইরে যেতে পারতাম না। তবে মেট্রোরেল নির্মাণের পর ভয় কিছুটা কেটেছে। মেট্রোরেল চালু হলে আমরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবো।
আরও পড়ুন: মেট্রোরেল উদ্বোধন, এলাকাবাসীর জন্য পুলিশের ৭ নির্দেশনা প্রকল্পে বর্তমানে এক হাজার ৬৫৪ বর্গফুটের তিন বেডের ফ্ল্যাট মাত্র ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যায়। যাতায়াত সুবিধা না থাকা এবং দৈনন্দিন হাট-বাজারে অসুবিধার কারণে ভাড়াটিয়ারা এখনো প্রকল্পের দিকে ঝুঁকছেন না। আগামী ২৮ ডিসেম্বর নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, মেট্রোরেল চালুর মধ্য দিয়ে আবাসন প্রকল্পে আর ভুতুড়ে পরিবেশ থাকবে না। জৌলুস ফিরবে পুরো এলাকায়।
মূলত, যাতায়াত সুবিধা না থাকা ও নিরিবিলি পরিবেশই কাল হয়েছে আবাসনের বাসিন্দাদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অপরাধীচক্রের অনেকে কম ভাড়ায় সেখানকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। মেট্রোরেল চালু হলে আবাসনে ব্যস্ততা যেমন বাড়বে ফ্ল্যাট মালিকেরাও দেখেশুনে পছন্দমতো ভালো ভাড়াটিয়া তুলতে পারবেন। সেখানকার বাসিন্দা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকায় থেকেও আমরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। মেট্রোরেলের আশায় এখানে এসেছি। কিন্তু আবাসন এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ। তবে মেট্রোরেল চালু হলে আমরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবো। কারণ, আমার ফ্ল্যাট থেকে মেট্রোরেল স্টেশনের দূরত্ব হেঁটে মাত্র ১০ মিনিট। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। অনেকের ধারণা ছিল, সেখানকার ফ্ল্যাট হবে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত। নির্মাণাধীন এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে রাজউকের দেওয়া কঠিন শর্ত মেনে একটা ফ্ল্যাট পেতে কোটি টাকা গুনতে হবে। যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের পক্ষে কঠিন। তারপরও অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। আর এই সুযোগে অনেক অপরাধী নাম-পরিচয় লুকিয়ে সেখানে নির্বিঘ্নে বসবাস করছেন।
কলাবতী ভবনের সভাপতি মোহাম্মদ নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। অপরাধীদের কেউ কেউ এই সুযোগ নিচ্ছেন। সম্প্রতি এক আদম কারবারিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। বিদেশে লোক পাঠানোর নামে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময় অপরাধীচক্রের সদস্যদের এখান থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবে আমার বিশ্বাস, মেট্রোরেল চালু হলে এসব ঘটনা থেকে মুক্তি পাবো। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে রাজউক। রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্বের ১৮ নম্বর সেক্টরে ২১৪ দশমিক ৪৪ একর জমির ওপর ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ‘এ, বি এবং সি’- এ তিন ব্লকে ফ্ল্যাট হবে ১৫ হাজার ৩৬টি। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৯ হাজার ৩০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রকল্পে ১৭৯টি ১৬ তলা ভবন হবে। ‘এ’ ব্লকের কাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লকের কাজ শুরুর কথা রয়েছে। ‘এ’ ব্লকের ৭৯টি ভবনে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট প্রস্তুত করা হয়েছে।
রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ মোজাফফর উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে আবাসন প্রকল্প নেওয়া হয়। আবাসনের বাসিন্দাদের মূল শহরে সংযোগ তৈরি করবে মেট্রোরেল। কারণ, আবাসন এলাকা থেকে হেঁটে সহজেই রেলস্টেশনে যাতায়াত করা যাবে। ফ্ল্যাট বরাদ্দ শেষ পর্যায়ে, কিন্তু এখনো অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। মেট্রোরেল চালু হলে ফ্ল্যাটগুলোতে দ্রুত বাসিন্দারা চলে আসবেন। তখন আর জনশূন্য নিরিবিলি পরিবেশ থাকবে না। মেট্রোরেল এ আবাসনের জন্য আশীর্বাদ।
রাজউকের উদসাীনতায় তৃতীয় পর্বের অন্য সেক্টরগুলো অন্ধকারে
উত্তরা আবাসিক শহর তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমান অগ্রগতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) হিসাবে ৮৩ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় মোট প্লট ৮ হাজার ২৯৫টি। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৫ শতাংশ প্লট। তবে ১৮ নং সেক্টর ছাড়া ২৪ বছরে উন্নয়নের তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি প্রকল্প এলাকায়। প্লটে আবাসনের বদলে কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন নার্সারি। অধিকাংশ প্লটই পড়ে আছে খালি। গত ২৮ ডিসেম্বর স্বপ্নের মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন প্লট মালিকরা।
রাজউক সূত্র জানায়, আবাসনের চাহিদা পূরণসহ মূল রাজধানীতে যানবাহন ও জনঘনত্বের চাপ কমাতে ১৯৯৯ সালে উত্তরা আবাসিক শহর (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্প হাতে নিয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দীর্ঘ ২৪ বছরেও এ প্রকল্প এলাকায় আবাসন নির্মাণে গতি পায়নি। উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পকে চারটি সেক্টরে (১৫-১৮) ভাগ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাকিগুলো আবাসিক সেক্টর।
প্রকল্পভুক্ত প্লটের প্রায় সবই বরাদ্দ হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু অধিকাংশ প্লটেরই সীমানা চিহ্নিত বা নির্ধারণ করা হয়নি। অনেককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি প্লট। অনেক প্লটে যাতায়াতের রাস্তাও নেই। নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাজার। মাটি ভরাটের কাজও বাকি একেকটি ব্লকের একেক স্থানে। অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক ছাড়া কোনো ব্লকেই পুরোপুরি মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়নি। ১৬৫ কিলোমিটার রাস্তার কাজও শেষ হয়নি। কয়েকটি প্রধান সড়ক হয়েছে মাত্র। প্লটে প্লটে সংযোগ সড়ক এখনো হয়নি।
যেসব প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটিতে ভবন উঠেছে। তবে নাগরিক সুবিধা না থাকায় বাসিন্দারা থাকতে পারছেন না। ১২টি সেতুর কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। মাটি ভরাটের কাজ ৪০ শতাংশ বাকি। স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডার কোনো কাজ হয়নি। কেবল একটি গির্জা তৈরি করা হয়েছে মাত্র। নেই কাঁচাবাজার। লেকের কাজও অসম্পন্ন। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্লটপ্রাপ্তরা শুধু অপেক্ষায়, কবে তারা প্লট বুঝে পাবেন। কিছু কিছু সমস্যা ছিল এগুলো নিরসনে নতুন করে পদক্ষেপ নিয়েছে রাজউক।
উত্তরা মধ্য স্টেশন থেকে কয়েক মিনিটের পথ বউবাজার। এখানে কাঁচাবাজার, স্টেশনারি, এসি-ফ্রিজ মেরামতসহ গড়ে উঠেছে কয়েকটি দোকান। চারদিকে যেন ধু ধু মাঠ। কয়েক জায়গায় গড়ে উঠেছে নার্সারি।
এখানে এসি-ফ্রিজ মেরামত করার দোকান দিয়েছেন প্রকাশ সরকার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন এখানে উন্নয়ন নেই। এখনো প্লট বরাদ্দ সম্পূর্ণ হয়নি। বউবাজার নামে একটি বাজার গড়ে উঠেছে। এখানে কাঁচাবাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করা যায়। আশা করছি এখন এখানে মানুষের বসতিও শুরু হবে।
আরও পড়ুন: ডিসেম্বরে ফজরের পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরা উত্তর স্টেশনের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর সেক্টরে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে নাগরিক সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে গ্যাস, স্যুয়ারেজ লাইন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। রান্না-বান্নায় বাড়তি দামে কেনা সিলিন্ডার গ্যাসই ভরসা।
উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে কথা হয় মো. গোলাম ফারুকের সঙ্গে। তিনি বটতলা গোলচত্বরে মেসার্স রাজিয়া ইলেকট্রিক অ্যান্ড হার্ডওয়্যারের নামে দোকান খুলেছেন। গোলাম ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরা তৃতীয় ফেজ এখনো বসবাসের যোগ্য হয়ে ওঠেনি। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো, রয়েছে বিদ্যুৎ সুবিধা। এর বাইরে গ্যাস, ওয়াসার পানি ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই। মশার কামড়ে অতিষ্ঠউত্তরা তৃতীয় ফেজের বাসিন্দারা জানান, এখানে দিনের চেয়ে সন্ধ্যার পর মশার উৎপাত কয়েকগুণ বেশি। রাতে মশার কয়েল জ্বালিয়েও নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার নালাগুলো পরিষ্কার করলে হয়তো মশা থেকে নিস্তার পাওয়া যেত। নেই ময়লা-আবর্জনা ফেলার নির্ধারিত স্থান। যে যেখানে পারছেন, সেখানেই বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
জমে থাকা পানি থেকে জন্ম নিচ্ছে মশা। চারদিক ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। ছোট-বড় অসংখ্য নালা। এসব নালায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির নোংরা পানি জমা থাকে।
মেট্রোরেল উত্তরা উত্তর স্টেশনের কাছে একটি বাসায় বসবাস করেন আমিনুল ইসলাম। তিনি নবনির্মিত একটি বাসার কেয়ারটেকার। মশার উৎপাত প্রসঙ্গে আমিনুল বলেন, শুধু রাত নয়, দিনেও মশা কামড় দেয়। কয়েল জ্বালিয়েও কোনো কাজ হয় না। নেই কাঁচাবাজাররাজউক উত্তরা তৃতীয় ফেজ এলাকায় কিছু বসতি গড়ে উঠলেও কাঁচাবাজারের তেমন কোনো সু-ব্যবস্থা নেই। উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর ও বউবাজারে কাঁচাবাজার গড়ে উঠলেও রাজউক থেকে দুদিন পর পর ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের যেতে হয় উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের খালপাড় অথবা ১২ নম্বর।
মিরপুর ১৫ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা হোসেন সিকদার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে বসবাসের অন্যতম সমস্যা পর্যাপ্ত কাঁচাবাজার নেই। মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে খালপাড়ে যেতে হয় বাজার-সদাই করতে। রিকশা অথবা অটোভাড়া লাগে ৩০-৪০ টাকা। ২০ টাকার কাঁচামরিচ কিনতে অনেক সময় ৪০ টাকা করে দুবার ৮০ টাকা যাতায়াত ভাড়া দিতে হয়।
যা বলছে রিহ্যাবউত্তরা তৃতীয় ফেজের প্লটগুলোতে দ্রুত সময়ে বসবাসের যোগ্য করার আহ্বান জানিয়েছে দেশের আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)।
রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, রাজউক জমি অধিগ্রহণ করে যেভাবে বরাদ্দ দিলো তাতে কি মানুষ বসবাস করতে পারবে? এই প্রশ্ন আমার নয়, এটা প্লট বরাদ্দ পাওয়া মানুষের প্রশ্ন। আমার মনে হয় দু-চার বছরেও এখানে কেউ বসবাস করতে পারবে না। মেট্রোরেল হলেও বসবাস যোগ্য হয়নি উত্তরা তৃতীয় ফেজের প্লটগুলো। মেট্রোরেল সরকারের বিরাট একটা অর্জন। অথচ মেট্রোরেল যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে নেই নাগরিক সেবা। এখানে এক হাজার প্ল্যান পাস করা হয়েছে, কিন্তু কোনো নাগরিক সুবিধা নেই। এখানে স্কুল-কলেজ নেই, চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই, পানি নেই, গ্যাসও নেই। তিনি আরও বলেন, যখন মেট্রোরেল নির্মাণের গুঞ্জন শুরু হয়, তখন উত্তরা তৃতীয় ফেজে প্রতি কাঠা জমির দাম ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ছিল। এখন জমির দাম এক কোটি টাকার নিচে নেই। এখানে প্রজেক্ট তৈরি হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা মেট্রোরেলের অর্জন ঘরে তুলতে পারছি না। রাজউক যে থার্ড ফেজ তৈরি করলো, নিজেদের ভবনের ফ্ল্যাটগুলোও বিক্রি করতে পারলো না। রাজউক হাজার হাজার প্লট বরাদ্দ দিলো অথচ কোনো লোককে সেখানে নিতে পারলো না। বরাদ্দ দেওয়া প্লট এখনো বসবাসের যোগ্য হয়নি।
রাজউক জানায়, প্রকল্পটি ২০১০ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিন দফা। প্রকল্প শুরুর সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪৪ কোটি টাকা। দীর্ঘসূত্রতার কারণে আরও ২৯৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে পরে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। একে একে ২৪টি বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ অনেক প্লট এখনো খালি। কিছু প্লটে আবাসনের বদলে নার্সারি তৈরি করা হয়েছে। ২০০৯ সালে এ প্রকল্পের একাংশে ‘উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প’ হাতে নিয়েছিল রাজউক। ২০১৬ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এটিও শেষ করতে পারেনি। কিছু ফ্ল্যাটে বাসিন্দা উঠলেও নাগরিক সুবিধা না থাকায় হতাশ তারা। তবে এই আবাসন এলাকায় নতুন করে আলো ছড়াচ্ছে মেট্রোরেল। তবুও সংশয় কাটছে না প্লট বরাদ্দ নেওয়া মানুষদের। উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের সাবেক পরিচালক হাফিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্লটগুলোতে ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। সামনে আরও অনেক বেশি ভবন হবে। ১৮ নম্বর সেক্টরে ভবনের কাজ চলছে। বি ও সি ব্লকেও কাজ চলমান। আগামী বছর আরও প্লটে নির্মাণকাজ শুরু হবে। বাণিজ্যিক কিছু প্লট দেওয়া হয়েছে। সাতটি ব্লকে নির্মিত হয়েছে সাতটি টাওয়ার। ‘এছাড়া ওয়াসার একটি খাল নির্মাণ করা হয়েছে। খালের কারণে কিছু প্লট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো রিপ্লেস করা হচ্ছে। কিছু কিছু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন ফুল সুইংয়ে কাজ চলছে। মেট্রোরেলের কারণে প্লটে বেড়েছে আবাসনের গতি।’
তিনি আরও বলেন, কিছু কাজ এখনো বাকি। লেকের কাজ ৩০ শতাংশ বাকি। মোট প্লট ৮ হাজার ২৯৫টি। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৫ শতাংশ। প্রকল্পের ১০০টি প্লটে আবাসন নির্মাণকাজ চলমান। মেট্রোরেল উদ্বোধনের কারণে প্রকল্পের প্লটে আবাসন নির্মাণের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। তবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি, কারণ সরকার নতুন করে গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে না।’
এমওএস/এমকেআর/এএসএ/জিকেএস