দেশজুড়ে

অভিযানে ভীত হয়ে মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছে অপহরণকারীরা

টেকনাফের বাহারছড়ার জাহাজপুরা পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহরণের শিকার আটজন অবশেষে ছাড়া পেয়েছেন। চার দিনের মাথায় জনপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুক্তিপণ পরিশোধের পর বুধবার (২১ ডিসেম্বর) দিনগত রাত ২টার দিকে তারা ছাড়া পান বলে জানিয়েছেন ভিকটিমদের স্বজনরা।

Advertisement

ফিরে আসা ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের সঙ্গে নিয়ে বিকেলে অপহরণস্থল পরিদর্শন করে টেকনাফ থানা ও কক্সবাজার জেলা পুলিশ। তবে পুলিশের দাবি, অভিযানে ভীত হয়ে মুক্তিপণ ছাড়াই তাদের ছেড়ে দিয়েছেন অপহরকারীরা।

এদিকে ভিকটিমরা জানিয়েছেন, মুক্তিপণের দাবিতে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালান অপহরণকারীরা। ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হয়নি। পুলিশের অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন তারা।

অপহরণের শিকার সেলিমের বড় ভাই আকতার হোসেন বলেন, ‘শুরু থেকেই জনপ্রতি তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছিলেন অপহরণকারীরা। এরমধ্যে পুলিশ ও শৃঙ্খলাবাহিনী জনগণকে নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে তল্লাশি এবং গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় পুলিশ ও সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে শাারীরিক নির্যাতন চালায় সন্ত্রাসীরা। এর মধ্যেও তাদের সঙ্গে দেনদরবার চলছিল। তাদের চাহিদামতো টাকা দিতে রাজি হওয়ার পর বুধবার রাতে তারা জাহাজপুরা গর্জন বাগানের কাছাকাছি আসেন। সেখানেই মুক্তিপণ নেওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।’

Advertisement

বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন বলেন, ভিকটিমের পরিবার এবং নানা সূত্রে খবর নিয়ে জেনেছি বিনা মুক্তিপণে তারা ফিরতে পারেননি। কিন্তু কত টাকা পণ দিয়ে তারা ফিরেছে বিষয়টি খোলাসা করছেন না কেউ।

তবে, অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, সবমিলিয়ে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেই আটজন ছাড়া পেয়েছেন। পারিবারিক আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই টাকার পরিমাণ নির্ধারণ হয়েছে বলেও উল্লেখ করে সূত্রটি।

অপহরণকারীদের কবল থেকে ফিরে আসা ভিকটিম রিদুয়ান জানায়, শখ করে পাহাড়ের ছড়ায় মাছ শিকারে গিয়ে তারা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের জিম্মিদশায় পড়েন। অস্ত্রের মুখে তাদের গভীর পাহাড়ের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গাছের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় ঢুকিয়ে রাখা হয়। ফিল্মি স্টাইলে একেকজনকে একেকভাবে বেঁধে রাখা হয়। কাউকে বেঁধে এ ঠান্ডার মধ্যেই পাহাড়ি ছড়ার পানিতে ভিজিয়ে রাখে। পালাকরে তাদের বেত্রাঘাত করা হতো। তাদের কথা ছিল, মুক্তিপণ দিলে মুক্তি মিলবে, বাড়ি যাওয়া যাবে।

ভিকটিম রিদুয়ানের ভাষ্য, ‘অপহরণকারী অস্ত্রধারী গ্রুপের লিডারের হাতে ল্যাপটপ ছিল। তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত নিউজসহ পুলিশের অভিযান বিষয়ে প্রতিনিয়ত খোঁজ নিয়েছে। অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে তারা বেশি নিযার্তন করেছে।’

Advertisement

ভিকটিম মোস্তফা কামালের ভাই হাবিব উল্লাহ জানায়, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা অপহৃত ভিকটিমদের অমানবিক নির্যাতন করেছে। এতে অনেকে জখম হয়েছেন। এদের মধ্যে মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন জাহাজপুরার বাসিন্দা মৃত কাদের হোসেনের ছেলে নুরুল হক (৫৫) ও ছৈয়দ আমিরের ছেলে করিম উল্লাহ (২২)।

ফিরে আসা ভিকটিমরা জানান, অপহরণকারীরা তাদের বেঁধে রেখে মারধর করতেন। ঠিকমতো খাবার দেননি। অথচ তারা পাহাড়ি হরিণ শিকারের পর মাংস রান্না করে পিকনিকের মতো করে খেয়েছেন। আস্তানায় অবস্থানের জন্য অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের অপহরণের পর পুলিশ-সাংবাদিক বা তাদের পরিবারের লোকজন কে কী বলছেন এবং কী করছেন তা মুহূর্তে খবর পেতেন তারা। এসব বিষয় নিয়ে তাদের মারধর ও হত্যার হুমকি দেওয়া হতো।

এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা দেনদরবার করে কেউ দুই লাখ, কেউ এক লাখ ও কেউ ৫০ হাজার করে টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। রাতের আঁধারে গর্জন বাগানের কাছে এনে নিজেরা টাকা বুঝে নিয়ে অপহৃতদের পরিবারে কাছে হস্তান্তর করেন।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হালিম বলেন, এ ঘটনায় অপহরণের শিকার হাবিবউল্লাহ মামলা করেছেন। এতে অপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

এদিকে ভিকটিমদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাহফুজুল ইসলাম। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে এসপি বলেন, জাহাজপুরায় আটজন অপহরণের ঘটনায় ভিকটিমের পরিবার পক্ষ থেকে লিখিত পেয়ে অভিযানে নামে পুলিশ। সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি ড্রোনের সাহায্যে পাহাড়ে নজরদারি বাড়ানো হয়। এতে অপহরণকারীরা ভয় পেয়ে রাতের আঁধারে কোনোধরনের মুক্তিপণ ছাড়াই ভিকটিমদের সুস্থ অবস্থায় ছেড়ে দেন।

এরআগে গত ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে জাহাজপুরা এলাকা থেকে অপহরণ হন জাহাজপুরা এলাকার বাসিন্দা রশিদ আহামদের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, একই এলাকার ছৈয়দ আমিরের ছেলে মোস্তফা কামাল, মমতাজ মিয়ার ছেলে রিদুয়ান, রুস্তম আলীর ছেলে সেলিম উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে করিম উল্লাহ, কাদের হোসনের ছেলে নুরুল হক ও নুর মোহাম্মদ এবং রশিদ আহমদের ছেলে আবছার।

সায়ীদ আলমগীর/এসআর/জেআইএম