জাতীয়

এক বই পড়ছেন কয়েকজন মিলে, ফটোকপিতেও ভাগাভাগি

# দাম না বাড়লেও কালি কমেছে কলমে, খাতায় পৃষ্ঠা কম# দাম বাড়ায় বিক্রি কম, লোকসানের মুখে বিক্রেতারা# দাম বাড়ানো হয়নি, দাবি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের

Advertisement

বাসাভাড়া ও খাবারের দাম বাড়তি। এর মধ্যেই বাড়ছে কাগজ-কলম ও বইয়ের দাম। অনেক সময় এক বই কয়েকজন মিলে পড়ছি। কিছু ফটোকপি করছি। ফটোকপিও দু-তিনজনে ভাগাভাগি করে পড়ছি। একসঙ্গে এভাবে পড়লে অনেক সময়ই পড়ায় মনোযোগী হওয়া সম্ভব হয় না। এভাবে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য।

শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়া নিয়ে জানতে চাইলে এভাবে নিজের প্রতিদিনের লড়াইয়ের কথা জানান মোক্তাদির হোসেন। তিনি এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গ্রামে বাড়ি। বর্তমানে থাকছেন ফার্মগেটে ভাড়া বাসায়।

শিহাব মজুমদার নামে আরেক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ায় ফটোকপির খরচও বেড়েছে। দুই পাশে ফটোকপি করতে এখন খরচ পড়ছে চার টাকা। আগে এটার খরচ ছিল দুই টাকা। প্রিন্ট করতে খরচ হচ্ছে ২০ টাকা।’

Advertisement

শুধু মোক্তাদির ও শিহাব নন, তাদের মতো অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ছে শিক্ষা উপকরণের বাড়তি দামে। বাবা-মায়ের সীমিত আয় থেকে টাকা নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, গত বছর কাগজ, মার্কার, স্কেল, খাতাসহ শিক্ষা উপকরণের দাম যা ছিল, তা এক বছরের ব্যবধানে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। অর্থাৎ আগে যেখানে ১০০ টাকা খরচ হতো, এখন সেখানে খরচ হচ্ছে ১৫০ টাকা। এরপরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। এ দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে।

শওকত হোসেন নামে এক অভিভাবক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাগজের রিমের দাম তো দ্বিগুণ হয়েছে। দেখা যাবে, বইয়ের দামও আকাশচুম্বি হবে। কলম, পেন্সিল না হয় কম কিনে চালানো যাবে। কিন্তু বই-খাতায় অনেক খরচ হবে। সেটা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। ৩০০ টাকা রিম কাগজ ৫০০ টাকা ছাড়িয়েছে। স্কুলের বেতন ও ভর্তি ফি বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের (অভিভাবক) অবস্থা খুবই খারাপ।’

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার স্টেশনারি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের কাগজ, ফাইল, জ্যামিতিক বক্স, পেন্সিল, রাবার, কলমের বক্স, মার্কার, স্ট্যাপলার, পিন, স্কেল, কার্টার, ক্যালকুলেটর, ক্লিপবোর্ড, প্রিন্টারের কালিসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহৃত প্রায় সব উপকরণের দাম বেড়েছে। তবে কলমের দাম না বাড়লেও কালি কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

Advertisement

দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাদা কাগজের পাশাপাশি নিউজ প্রিন্ট কাগজের দামেও ঊর্ধগতি। তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি রিম নিউজ প্রিন্ট কাগজে আড়াইশো টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ৭২ পৃষ্ঠার ব্যবহারিক খাতা ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। ভালোমানের জ্যামিতিক বক্সের দাম ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০ টাকা হয়েছে। এক ডজন পেন্সিল ৭০ থেকে বেড়ে ৯০ টাকা, প্রতি পিস রবার ও সার্পনার ৫-১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

বিক্রেতারা বলছেন, ডিসেম্বরে সাধারণত কম বিক্রি হয়। জানুয়ারিতে বিক্রি বাড়ে। তবে এবার দাম বাড়ায় বিক্রি যে কমবে, সেটা আগেই অনুমান করা যাচ্ছে। কলমের দাম ক্রেতাদের জন্য বাড়েনি। তবে বিক্রেতারা কমিশন কম পাচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্যবসার অবস্থা ভালো না বলে দাবি তাদের।

বাড্ডা এলাকার ‘ইত্যাদি স্টেশনারি’র মালিক মজিবুর রহমান জিসান। তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে স্টেশনারি পণ্যের দাম বাড়ছে। কাগজের দাম ছুটছে তো ছুটছেই। থামানোর কেউ নেই। ২০০ পৃষ্ঠার খাতা ছিল ৭০ টাকা। সেটা এখন ৮৫ টাকা হয়েছে। ১২০ পৃষ্ঠার সাদা খাতার দাম ৩৫ থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় ঠেকেছে। অন্যান্য খাতা ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যে রিম ছিল ২৮০ টাকা, সেটা এখন ৫০০ টাকার বেশি। কলম ও পেন্সিলের দাম ঠিক আছে। কিন্তু সেগুলোতে বিক্রেতাদের কমিশন কমেছে। যেটা আগে আমাদের তিন টাকায় কেনা ছিল, সেটা এখন চার টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। আবার কালি কমেছে বলে অভিভাবকরা অভিযোগ করছেন।

অন্যান্য পণ্যের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্যালকুলেটর, কার্টার, স্ট্যাপলারের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রং পেন্সিলের দাম ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এসব পণ্যেও বিক্রেতাদের লাভ কমেছে। আঠা যেটা স্টিকি সেটা আগে কেনা ছিল ২২ টাকা, এখন ২৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে। মার্কার ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা কালারের পেন্সিল ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অফিস ফাইল ৩০ টাকা ছিল, সেটা এখন ৪৫ টাকা। স্টিলের স্কেলের দাম ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

ক্রেতারা আগের দামেই কিনতে চান জানিয়ে মজিবুর রহমান জিসান বলেন, ‘এসব পণ্যের যে দাম বেড়েছে, সেটা ক্রেতারা বিশ্বাস করতে চান না। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডায়ও জড়িয়ে পড়েন অনেকে। সবমিলিয়ে ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।’

তমা স্টেশনারির মালিক আরিফ হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব পণ্যের দাম বাড়ছে। কলমের দাম ক্রেতাদের জন্য হয়তো বাড়েনি। আমাদের কমিশন কমে গেছে। কলমে কালির মতোই খাতায় পৃষ্ঠা কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করছেন ক্রেতারা। কমেছে কি না, এটা তো আমরা বলতে পারি না। কারণ আমরা ব্যবহার করি না। কোম্পানি এটা ভালো বলতে পারবে।

তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরে সাধারণত বিক্রি কম হয়। জানুয়ারিতে বিক্রি বাড়ে। তবে এবার দামের যে অবস্থা, বিক্রি যে খুব একটা ভালো হবে না সেটা আগেই অনুমান করা যাচ্ছে। ক্রেতারা হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু করার তো কিছু নেই। বাধ্য হয়ে কিছুটা কমিয়ে কিনছেন তারা। এজন্য ব্যবসাও কমেছে আমাদের।’

তবে কলমের কালি কমানো ও অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ানো হয়নি বলে দাবি করেন স্টেশনারি প্রতিষ্ঠান ম্যাটাডরের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. আরিফ।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত হয়নি। দাম আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই। সেভাবেই সব বিক্রি চলছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাজার একটু স্লো। এখন আগের তুলনায় বিক্রিও কম।’

এসএম/এএএইচ/এসএইচএস/এএসএম