অর্থনীতি

চাষের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় বাংলাদেশ

দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখা, উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে অব্যাহত ভূমিকা রেখে চলেছে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি সর্বোপরি দারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্যখাতের অবদান অনস্বীকার্য। করোনা সংকটের মধ্যেও দেশে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদন সরবরাহ ও বিপণন স্বাভাবিক রাখা হয়েছে।

Advertisement

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী করোনার মধ্যেও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে (ছয় বছর ধরে পঞ্চম অবস্থানে ছিল), যা ২০২২ সালে মৎস্য খাতের অনন্য এক অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন: এক যুগে দেশি মাছের উৎপাদন চারগুণ বেড়েছে

Advertisement

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ১ কোটি ৯৫ লাখ বা ১২ শতাংশের অধিক মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মৎস্য ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজসম্পদের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে উন্মুক্ত জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সুফলের মাধ্যমে দরিদ্র্য মৎস্যজীবী ও মৎস্যচাষি তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।

মৎস্য খাতের সাফল্য

২০২১-২২ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭.৫৯ লাখ মেট্রিক টন; যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০.৬২ লাখ মেট্রিক টন) চেয়ে ৫৫.৪২ শতাংশ বেশি। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭.৫৪ লাখ মেট্রিক টন। ৩৮ বছরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ছয় গুণের অধিক। মৎস্য খাতে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৫.৭৪ শতাংশ। দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপি’র ২৬.৫০ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান।

বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ১.২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৪২.৬৭ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯১.৭৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬.৯৬ শতাংশ বেশি।

Advertisement

আরও পড়ুন: ১০ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৭৯ শতাংশ

দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মৎস্য এবং মৎস্যপণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি স্থাপন ও পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রণয়ন করা হয়েছে মৎস্য ও মৎস্য পণ্য মাননিয়ন্ত্রণ আইন ২০২০।

তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনেও সফল বাংলাদেশ-ছবি জাগো নিউজ

স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। ইলিশ আহরণে প্রথম (বর্তমানে ইলিশের মোট উৎপাদন ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টন) অবস্থানে রয়েছে।

সুনীল অর্থনীতির বিকাশে সমুদ্রে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদ অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং তা এসডিজির সঙ্গে সমন্বয় করে হালনাগাদ করা হয়েছে। এরই মধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ ও সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের সমুদ্রসীমায় মনিটরিং, কন্ট্রোল ও সার্ভিল্যান্স জোরদারকরণে ১০ হাজার আর্টিসানাল মৎস্য নৌযান ও ৫টি বাণিজ্যিক মৎস্য নৌযান প্রযুক্তিভিত্তিক ভেসেল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আনা হয়েছে।

আরও পড়ুন: চাকরির পেছনে না ছুটে শোল মাছ চাষে ভাগ্যবদল

মাছ সংরক্ষণের অংশ হিসেবে ৩৭ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক। জিন ব্যাংকে এখন পর্যন্ত ১০২ প্রজাতির মাছ সংরক্ষিত আছে।

আরও পড়ুন: মাছের প্রথম জিন ব্যাংক ময়মনসিংহে

রুই মাছের দ্রুত বর্ধনশীল ও অধিক উৎপাদনশীল নতুন জাত বিএফআরআই সুবর্ণ রুই উদ্ভাবন করা হয়েছে।

জেলেদের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করছে মৎস্য অধিদপ্তর-সংগৃহীত ছবি

মৎস্যজীবী-জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান

মৎস্য অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৬ জন মৎস্যজীবী-জেলের নিবন্ধন এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে। ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী-জেলের নিবন্ধন ও ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজস্ব খাতের আওতায় জেলেদের নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান।

আরও পড়ুন: মাছের খাবারে মুরগির নাড়িভুঁড়ি

প্রাকৃতিক দুর্যোগে (ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস) এবং জলদস্যুর আক্রমণ, বাঘের থাবা, কুমির ও সাপের কামড়ের কারণে মৃত্যুবরণকারী ৫৮৭ জেলে পরিবারকে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ মেয়াদকালে মোট ২ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা অনুদানের অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ‘নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের আর্থিক সহায়তা প্রদান নীতিমালা-২০১৯’ অনুযায়ী ২০২০-২১ আর্থিক সালে স্থায়ীভাবে অক্ষম দুজন জেলেকে ও ৪৯টি নিহত জেলে পরিবারকে মোট ২৫ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ আর্থিক সালে স্থায়ীভাবে অক্ষম ৮ জন জেলেকে ও ৪৯টি নিহত জেলে পরিবারকে মোট ২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

অপ্রচলিত মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ

কাঁকড়া হ্যাচারি স্থাপন এবং সফলভাবে ক্রাবলেট উৎপাদন: দেশে কোস্টাল অ্যাকোয়াকালচার ও মেরিকালচার সম্প্রসারণে কক্সবাজারের কলাতলীতে কাঁকড়া হ্যাচারি স্থাপন করা হয়েছে এবং সফলভাবে ক্রাবলেট উৎপাদন করা হচ্ছে।

সি-উইড ও ওয়েস্টার কালচার পাইলটিং: কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলা, টেকনাফ, মহেশখালী ও উখিয়া উপজেলার ০.৮ হেক্টর উপকূলীয় এলাকায় সি-উইড ও ওয়েস্টার কালচার পাইলটিং করা হচ্ছে।

হ্যাচারিতে কাঁকড়া উৎপাদন-ফাইল ছবি

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সরকার গৃহিত নানা উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অভ্যন্তরীণমুক্ত জলাশয়, অভ্যন্তরীণবদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ফলে এই অনন্য অর্জন। মৎস্যখাতে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের সফল বাস্তবায়নের ফলে বিগত এক দশক ধরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন: ৬০ হাজার টাকার মাছ চাষে কোটিপতি ওসমান

মাছের অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য খাতে গবেষণার উন্নয়ন, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশের মৎস্য খাতে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

তিনি বলেন, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৮ দশমিক ১৪ লাখ মেট্রিক টন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে পাঁচ গুণের অধিক। ২০২০-২১ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের চেয়ে ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। দেশের মৎস্য খাতের এ অর্জনে স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।

আরও পড়ুন: জিআই সনদ পেলো বাগদা চিংড়ি

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে কেবল ভারত ও চীন। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পঞ্চম অবস্থানে ছিল। এ অর্জন অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। এছাড়া এফএও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স ও ফিনফিশ উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১১তম স্থান অধিকার করেছে। এছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম, তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

করোনা সংকটের মধ্যেও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মৎস্য উৎপাদনে ভালো করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

আইএইচআর/এসএইচএস/জেআইএম