শ্রমের হাট, যেখানে দরদাম করে বেচাকেনা হয় মানুষের! কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও প্রতিদিন ভোরে এমনই ব্যতিক্রম হাট বসছে মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। তবে দাস কিংবা পণ্য হিসেবে নয়, মানুষের বেঁচাকেনা হয় শ্রমিক হিসেবে। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা চুক্তি অনুযায়ী নিজেদেকে বিক্রি করেন শ্রমিক ও কৃষকরা।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, দেশের আলু উৎপাদনে শীর্ষ জেলা মুন্সিগঞ্জের বিস্তীর্ণ জমিতে এখন চলছে আলু আবাদ। বছরের কয়েক মাস জুড়ে আলু আবাদ ও উত্তোলনে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সৃষ্টি হয় এই জেলায়। আলু রোপণ ও উত্তোলনকে কেন্দ্র করে জেলাজুড়ে দেখা দেয় বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রমিকদের আগমন ঘটে এ জেলায়। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা চুক্তি হিসেবে এসব মানুষ বিভিন্ন জনের জমিতে কাজ করার বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
প্রতিদিন ভোরে এসব শ্রমিকরা জেলার বিভিন্ন বাজারে জড়ো হয়ে থাকেন। সেখান থেকে জেলার কৃষকরা শ্রমিকদের শ্রমের দরদাম করে নিজ জমিতে কাজে লাগান। জেলার বিভিন্ন স্থানে এমন হাটের দেখা মিললেও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বালিগাঁওয়ে জমে সবথেকে বেশি।
সরেজমিনে বালিগাঁও বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের দুই পাশে সড়কে অসংখ্য নারী-পুরুষের জটলা। হাটে বিকিকিনি হচ্ছে তাদের শ্রম। একাধিক কৃষকের সঙ্গে পুরুষ শ্রমিকরা চুক্তি অথবা দিনব্যাপী শ্রম বিক্রির পারিশ্রমিক নিয়ে দর-কষাকষি করছেন। চুক্তি শেষে কৃষকের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে আলু জমির দিকে চলে যাচ্ছেন।
Advertisement
সাধারণত শ্রমিকরা ১৫ থেকে ২০ জনের দলে বিভক্ত হয়ে থাকেন। আলু রোপণ কাজে যুক্তদের মধ্যে নারী শ্রমিকও রয়েছেন। শ্রম বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে এইসব দিনমজুর বা শ্রমিকদের।
জীবিকার তাগিদে ছুটে আসা এসব শ্রমিকের অধিকাংশেরই বাড়ি দেশের উত্তরবঙ্গে। আলু রোপণ ও উত্তোলন মৌসুমে তারা মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও চরাঞ্চলের এই জনপদে আসেন।
বালিগাঁও গ্রামের মো. সেলিম হোসেন জানান, প্রতিদিন সকালেই শ্রম বিক্রির হাট বসে বালিগাঁও বাজারসহ আশপাশ গ্রামের পথে-প্রান্তরে। রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার অসংখ্য নারী-পুরুষ কেনাবেচা হয় এই হাটে।
গাইবান্ধা জেলার বণিকপাল বলেন, আমরা প্রতিবছর এসময় চলে আসি। প্রায় ৬ মাস এখানে থাকি। এবার ১০ জন এসেছি। বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। রোজ ৬০০ টাকা দাম হাঁকি। কিন্তু বাজারের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বলে। বাজার ভালো থাকলে কোনো কোনো সময় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা রোজে কাজ করি।
Advertisement
ওমর ফারুক বলেন, প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উঠে বালিগাঁও বাজার এলাকায় লাইনে থাকতে হয়। মালিকদের সঙ্গে দরদাম হলে কাজে লেগে যাই। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আলু রোপণ কাজে প্রতিদিন ৩৫০ টাকা ও মাঝে মাঝে ৪০০ টাকা পাই।
তবে পারিশ্রমিকের দিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উত্তরবঙ্গের এসব শ্রমিকদের। তারা অভিযোগ করেন, স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় তাদের কম পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে। অথচ তারা একই পরিশ্রম করছেন।
রংপুর থেকে আসা নারী শ্রমিক অঞ্জুলী দাস বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের মতো তারা একই পরিশ্রম করেন। কিন্তু তাদের মজুরি দেওয়া হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, আর আমাদের দেওয়া হয় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা।
মজুরি বৈষম্যের এ বিষয়টি নিয়ে জয়ন্ত্রী দাস, আমেলা বেগমসহ অপর নারী শ্রমিকরা একই কথা বলেন।
একই এলাকার নুরুজ্জামান বলেন, মালিকরা বিকেল পর্যন্ত কাজ করা লাগবে বলে নিয়ে যায়। পরে মাগরিবের পরে ছাড়ে। আমি ৬০০ টাকার নিচে যাই না। বসে থাকি, স্কুলের বারান্দায় রাতে থাকি। জমির মালিকরা সকালে রুটি, দুপুরে ভাত খাওয়ায়। এখানে কাজের মূল্যায়ন নেই। কে কাকে ঠকাতে পারে সেটাই ভালো যানে।
জমির মালিক আব্দুল খালেক বলেন, আমি বড়লিয়া থেকে আসছি। ভোরে এখানে এলে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যায়। আমার ৮ জন শ্রমিক লাগবে, তাই সকালে ফজরের নামাজ শেষে চলে আসছি। অন্য জায়গা থেকে এ জায়গায় শ্রমিকের মূল্য একটু কম।
এ বিষয়ে টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. রাশেদুজ্জামান বলেন, কলকারখানা ও শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। যাতে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে। নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য নিয়ে যাতে তারা কাজ করে।
জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ৩৫ হাজার ৭৯৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আলু আবাদ ও উত্তোলন মৌসুমে এসব জমিতে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
এফএ/এমএস