একসময় ঝুট কাপড়কে আবর্জনার মতোই ফেলনা মনে করা হতো। তবে এ কাপড় আর ফেলনা নয়, ঝুটের তৈরি পাপোশে নওগাঁর বেশ কয়েকটি পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা। জেলার মহাদেবপুরে ঝুট কাপড়ের পাপোশ তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা।
Advertisement
স্থানীয় বাজারে এসব পাপোশের রয়েছে ব্যাপক কদর। তবে সফলতার পথে তাদের বড় বাধা অর্থ। প্রশিক্ষণসহ সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা থেকে সহযোগিতা পেলে কাজের পরিধি আরও বাড়বে বলে জানাচ্ছেন এ পেশার সঙ্গে জড়িতরা। সেইসঙ্গে এখান থেকে আরও অনেকের কর্মসংস্থান হবে বলেও জানাচ্ছেন তারা।
উত্তরের সমতল ভূমির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রধান পেশা কৃষি। বছরের কয়েকমাস কৃষি কাজ থাকলেও অধিকাংশ সময় তাদের অলস বসে থাকতে হয়। দরিদ্র এসব পরিবার তখন বেশ অর্থ সংকটে পড়ে। তবে দিন বদলাচ্ছে। এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। প্রায় তিন বছর আগে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় একটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় ২০ জন নারীকে পাপোশ তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে কাজ শুরু করে এখন তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাদের কাছ থেকে কাজ শিখে পাপোশ তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন প্রতিবেশী নারীরাও।
পাপোশ তৈরির সরঞ্জাম হিসেবে লাগে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ফ্রেম বা কাঠামো, যা তাঁত মেশিনের মতো। এর সঙ্গে দরকার হয় কাঁচি, ছড়া ও পানঞ্জা। এ কাঠামোতে নানা রঙের ঝুট কাপড় ও উলের সুতা তুলে পাপোশ তৈরি করা হয়।
Advertisement
উপজেলার জোয়ানপুর, বেলপাড়া, চেরাগপুর ও এনায়েতপুর গ্রামের আদিবাসী পল্লীর ৩৫ নারী এ পাপোশ তৈরি করছেন। শুরুতে প্রতিটি পাপোশ ৩০ টাকা মজুরিতে তৈরি করলেও এখন ঝুট কাপড় ও নানা রঙের উলের সুতা কিনে নিজেরাই তৈরি করছেন। নানা রঙের সুতায় পাপোশে ফুটে উঠছে নকশা। এ পাপোশ মহাদেবপুর বাজার এবং সান্তাহারে প্রতিটি ১১০ থেকে ১২০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঝুট কাপড় ও সুতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পাপোশে ৫০ থেকে ৬০ টাকা লাভ থাকে। সংসারের কাজের পাশাপাশি এসব পাপোশ তৈরি করে মাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা আয় করছেন গ্রামীণ নারীরা।
পাপোশ তৈরির প্রধান কাঁচামাল জোগান দেওয়া হয় বগুড়ার সান্তাহার থেকে। পুরুষরা সেখান থেকে ঝুট কাপড় ও উলের নানা রঙের সুতা কিনে আনেন। এরপর নারীরা পাপোশ তৈরি করেন। প্রতিকেজি ঝুট কাপড় ৩০ টাকা, উলের সুতা ৮০ টাকা এবং টানা সুতা ১৫০ টাকা দরে কিনতে হয়। তবে গত তিন মাসে ঝুট কাপড় ও সুতার প্রতিকেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা দাম বেড়েছে। এতে লাভের অঙ্ক কিছুটা কমেছে। পাপোশ তৈরি হলে পুরুষরা সেগুলো মহাদেবপুর এবং সান্তাহারে বিক্রি করেন।
জোয়ানপুর গ্রামের পাপোশ কারিগর সন্ধ্যা লাকড়া বলেন, এক সময় কৃষিকাজ করতাম। বছরে ছয় মাস কাজ থাকলেও বাকি সময় অলস বসে থাকতে হয়। কাজ না থাকলে অনেকটা কষ্ট করে দোকান থেকে বাকি নিয়ে সংসারে খরচ চালিয়ে নিতে হতো। তবে এখন আর অলস বসে থাকতে হয় না। তিন বছর আগে পাপোশ তৈরির ওপর তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সারাবছরই কাজ করছি।
তিনি বলেন, শুরুতে দোকানিরা ঝুট কাপড় আর সুতা সরবরাহ করতো। প্রতিটি পাপোশ তৈরির জন্য ৩০ টাকা মজুরি দিতো। এতে খুব একটা লাভ হতো না। গেলো এক বছর থেকে নিজেই ঝুট কাপড় ও সুতা কিনে পাপোশ তৈরি করছি। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটা তৈরি করা যায়। ঝুট কাপড় ও সুতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পাপোশে ৫০ থেকে ৬০ টাকা লাভ থাকে। প্রতি মাসে পাঁচ-সাত হাজার টাকা আয় হয়। সংসারের কাজে খরচের পর ও বাকি টাকা সঞ্চয় করতে পারছি।
Advertisement
আরেক কারিগর শান্তনা মিনজি বলেন, দুই বছর আগে শাশুড়ির কাছ থেকে পাপোশ তৈরির কাজ শিখেছি। এরপর চার হাজার টাকা দিয়ে পাপোশ তৈরির মেশিন কেনা হয়। সংসারের কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে দিনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয়।
তার মতো ওই এলাকায় আরও ছয়জন নারী এ কাজ করেন বলে জানান শান্তনা। এখন তারা কৃষি কাজ না করে বাড়িতে বসে বসে পাপোশ তৈরি করে সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে।
জোয়ানপুর গ্রামের বিলাশ লাকড়া বলেন, আমার স্ত্রী শান্তনা মিনজি পাপোশ তৈরি করে। তার জন্য ১০-১৫ দিন পর পর সান্তাহার থেকে ৫০ কেজি (২০ কেজি ঝুট কাপড় ও ৩০ কেজি সুতা) মালামাল কিনে আনি। আগে দাম একটু কম ছিল। গত তিনমাস থেকে প্রতিকেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এতে লাভ একটু কম হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। পুঁজি না থাকায় বেশি ঝুট কাপড় কেনা যায় না। যদি বেশি পরিমাণ কেনা যেত বেশি কাজ করা সম্ভব হতো। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হতো। সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ ঋণের ব্যবস্থা করা হলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়।
স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ী আবু তাহের নামে এক দোকানি বলেন, উলের এসব পাপোশের বেশ কদর রয়েছে। পাইকারি ১১০ থেকে ১২০ টাকা কিনে খুচরা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা পিস বিক্রি করা হয়। তবে এই পাপোশ আরেকটু রঙিন বা আকর্ষণীয় করলে ক্রেতাদের কাছে চাহিদা আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, যারা পাপোশ তৈরি করছে তারা দরিদ্র। সামান্য পুঁজি দিয়ে তারা এ ব্যবসা করছেন। পাপোশ তৈরির পর বিক্রি করে ওই টাকা থেকে তাদের কাঁচামাল কিনতে হয়। ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা গেলে তারা আরও লাভবান হবেন।
মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু হাসান বলেন, গ্রামীণ নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝুট কাপড়কে কাজে লাগিয়ে পাপোশ তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এটি নারীদের পরিবারের আয়বর্ধক কাজে যুক্ত করছে। তাদের প্রশিক্ষণসহ ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে আরও অনেকেই স্বাবলম্বী হবেন।
উপজেলা মাসিক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে তাদের সহযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন এ কর্মকর্তা।
এমআরআর/এএসএম