মতামত

বিএনপির ২৭ দফা শান্তির না সংঘাতের?

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত ১৯ ডিসেম্বর বিকালে গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের বলরুমে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আয়োজিত এক সম্মেলনে একটি রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। রূপরেখায় দেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে মেরামত করতে ২৭ দফা কর্মপরিকল্পনা পেশ করেন।

Advertisement

গত কয়েকদিন থেকেই বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। বিশেষত অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল এ কর্মপরিকল্পনায় ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকট ও বিশ্ব জুড়ে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের বার্তা থাকবে।

এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিও কাম্য ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম ২০০১ সালে বিএনপি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ২২ বছর পর প্রায় সেই একই ইশতেহার ঘোষণা করেছে ২৭ দফা নামকরণ করে, উপরন্তু প্রস্তাবনার শুরুতেই সংবিধান সংশোধনের সুস্পষ্ট বার্তা দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

২০০১ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি:বিএনপির ২৭ দফা কর্মপরিকল্পনায় উন্নয়নের কথিত বয়ান থাকলেও তা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, কিভাবে মন্দা মোকাবেলা করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা হবে এবং কোন কোন খাত থেকে কিভাবে অর্থনীতি সমৃদ্ধ করা হবে তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

Advertisement

একে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ আছে বলা মনে হয় না। তবে ২৭ দফা দেখে প্রথমে যে প্রশ্নটি জেগেছে তা হচ্ছে, প্রায় অর্ধ শতাব্দি পরিক্রমা করা একটি রাজনৈতিক দল কিভাবে ২২ বছর আগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আবর্তে আটকে থাকে! কয়েকটি প্রতিশ্রুতি বা দফা উল্লেখ করছি:১. দুর্নীতির মূলোৎপাটনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে২. প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীও সমপর্যায়ের সকলের সম্পদের হিসাব গ্রহণ ও প্রকাশ করা হবে।৩. দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে৪. `সকলের জন্য বিদ্যুৎ’ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন করা হবে।৫. আইনের শাসন নিরুঙ্কুশ করার জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে৬. আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সম্বলিত ‘অধিকার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ৭. গ্রহায়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রকল্প “পরিবেশ বাংলা” বাস্তবায়ন করা হবে।৮. দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য-বীমা ব্যবস্থা চালু করা হবে।৯. যাদের জন্য কোনরূপ কর্মসংস্থানেরই ব্যবস্থা নেয়া যাবে না তাদের জন্য বেকার ভাতা প্রবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।১০. রাষ্ট্রীয় কলকারখানা লাভজনক করতে উদ্যোগ নেয়া হবে। বন্ধ শিল্পসমূহ যথাসম্ভব সংস্কার ও আধুনিকায়ন করে পুনরায় চালু করা হবে।১১. নারীদের আরো কার্যকরী ভূমিকা পালন ও ক্ষমতায়নের জন্য তাদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে এবং মহিলা আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।১২. বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এবং জননিরাপত্তা (বিশেষ আইন) আইন ২০০০ বাতিল করা হবে।১৩. বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করবে।১৪. সকল ধর্মের নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

আরও বেশকিছু ক্ষেত্র উল্লেখ করা যায়, তবে সম্প্রতি পেশ করা দফার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উল্লেখিত দফাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ২০০১ এ ক্ষমতায় আসার পর এর ১টি দফাও বিএনপি পূরণ করে নি। নির্বাচিত হওয়ার পর একবারের জন্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা করা হয় নি।

বরং দুর্নীতি রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুর্নীতিতে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক করার পরিবর্তে প্রথম বছরেই সম্ভাবনাময় আদমজী জুট মিল বন্ধ করা হয়েছে, মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে সর্বোচ্চ মাত্রায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে এবং বিরোধী দল ও মত নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। অর্থাৎ সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায় বিএনপি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ঠিক তার বিপরীত কার্যক্রম করেছে।

বিএনপির ২৭ দফায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল, ফ্লোর ক্রসিং, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ রাখা ইত্যাদি মুখরোচক প্রতিশ্রুতি সহ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে। এ জাতীয় কথা ১৯৯১ সালেও বলা হয়েছিল। বিএনপি বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না - এমন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে? বিএনপিকে আস্থায় নেয়ার মতো কোনো কারণ কি আছে?

Advertisement

সংকটের পূর্বাভাস:বিএনপির ২৭ দফায় প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা যে সংঘাতের পথে যাবে তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন প্রথম দফাতেই পাওয়া যায়। আমরা কাঙ্খিত ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যেতে না পারলেও বর্তমানে সংবিধানে গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য আনা হয়েছে।

অভিশপ্ত ইনডেমনিটি বাদ দেয়া হয়েছে; হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সংবিধানে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে "সকল অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ রহিত বা সংশোধন" করা বলতে কি বুঝিয়েছে তা সুস্পষ্ট নয়।

তবে এটা অনুধাবন করা যাচ্ছে যে সংবিধানের প্রতি তাদের ক্রোধ ও বৈরি মনোভাব রয়েছে। তাই সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি মূলত প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির পূর্বাভাস দিয়েছে যা জাতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিবে বলে আশঙ্কা রয়েছে!

বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এক অর্থে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আদালত কর্তৃক দণ্ডিত তারেক রহমান আছেন লন্ডনে। গত ১২ বছর যাবত ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে দলটির প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও তারা প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে তারা সরে আসে নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

ক্ষমতালাভের জন্য অগ্নিসন্ত্রাস ও নৈরাজ্য থেকে শুরু করে তথ্য সন্ত্রাস, অপপ্রচার ও গুজবকে হাতিয়ার বানাতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। মানবাধিকার রক্ষার কথা বললেও ক্ষমতায় আসার আগেই অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণা, হুমকি, প্রতিহিংসা ও অরাজকতার উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় জনগণ কেন তাদের উপর আস্থা রাখবে সেটিই বড় প্রশ্ন! শান্তিকামী জনগণের জন্য বিএনপি কি কোনো পথ খোলা রেখেছে? বিএনপির ২৭ দফা শান্তির না সংঘাতের তা ভবিষ্যতই বলে দিবে।

লেখক: রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম