ফিচার

পালকির ইতিকথা

১৭৫৮ সাল। গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন সদ্য পরাজিত নবাবের প্রতারিত হওয়া নিশ্বাসে, বিশ্বাসঘাতক শ্বাসরুদ্ধকর বিষাক্ত বাতাস। যে অন্তঃশত্রু বাতাস ছুটে চলেছে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কোমল মাটি ছুঁয়ে। অথচ এত কিছুর মধ্যে কোম্পানির লোকেরা ভাবতে বসেছে অন্য আরেকটি বিষয়। একটি অতি সাধারণ প্রচলিত বাহন যা কি না ভাবনায় ফেলে দিয়েছে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের। কি সেই বাহন? এত অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে কোন বাহন নিয়ে শীর্ষস্থানীয় ইংরেজ কর্মকর্তাদের এত মাথাব্যথা? এত দুশ্চিন্তা?

Advertisement

পালকি, ইংরেজিতে পেলেঙ্কিউন বা সেডেন চেয়ার। সতেরো ও আঠারো শতকের বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের কর্তাব্যক্তিরা পড়লেন ভারি এক সমস্যার মধ্যে। নিত্যনৈমিত্তিক যাতায়াত, মালামাল স্থানান্তরে তারা অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন পালকির ওপর। তারা এতটাই অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন পালকিকে কেন্দ্র করে যে সে সময় মোটা টাকা মাইনে পাওয়া কর্তাব্যক্তিরা তো বটেই, কোম্পানির স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীরাও ব্যাপক মাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়লেন এই বাহনটির ব্যবহারে।

এতদূর পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল! কিন্তু বাঁধ সাঁধলো যে ব্যাপারটি তা হলো এসব নিম্ন আয়ের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা পালকি চড়ার নিমিত্তে প্রচুর অর্থবিয়োগ পুষিয়ে নিতে, লিপ্ত হতে থাকলেন পয়সা কামানোর নতুন সব অবৈধ কর্মকাণ্ডে। কেননা তখনকার দিনে পালকি ব্যবহার নিতান্তই মুখের কথা ছিল না!

এজন্য প্রচুর অর্থ গুনতে হতো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৮ সালে অর্থ্যাৎ বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন হারানোর কিছুদিনের মধ্যেই সাধারণ কর্মচারীদের পালকি ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোর্ট অব ডিরেক্টর্স থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি হলো।

Advertisement

পালকি হলো ঐতিহ্যবাহী, চালকবিহীন, বিলাসবহুল একপ্রকার প্রাচীন মনুষ্যবাহী যান। সাধারণত সেগুন, শিমুল, গণ গাছের শক্ত কাঠ দিয়েই প্রস্তুত করা হতো পালকি। পালকি বহন করার দণ্ড যা বাঁট নামে পরিচিত-তৈরি হয় বটগাছের শক্ত, মোটা ও বড় ঝুড়ি দিয়ে। যারা পালকি বহন করতেন তাদের কাহার বা বেহারা বলে সম্বোধন করা হতো। কিছু কিছু সম্প্রদায় যেমন বাগদি, বাঁউড়ি, হাঁড়ি, মাল, দুলে জনগোষ্ঠীর লোক পালকি বহন বা বেহারার কাজ করতেন।

ময়ূরপঙ্খি, আয়না ও সাধারণ এ তিন ঘরানার পালকির সঙ্গে আমরা পরিচিত। গড়নের ধাঁচ আলাদা হওয়ার বাহ্যিক কারণবশত পালকিগুলোর ধরন ও নাম আলাদা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে আকার আয়তনে সবচেয়ে বড় হলো ময়ূরপঙ্খি। যা নামের মতোই দেখতে অনেকখানি ময়ূরের মতো! পালকির ভেতরে দুটো চেয়ার, একটি টেবিল ও একটি তাক থাকতো এ ধরনের পালকিতে। আর নামানুসারে এর বাঁটটি মাথার দিকে হতো ময়ূরের মতো বাঁকানো।

আয়না পালকিতে এর নামের আদলে আয়না বসানো থাকতো। ভেতরে থাকতো ময়ূরপঙ্খির মতো দুটো চেয়ার ও মধ্যখানে মধ্যমণি হয়ে থাকতো একটি ছোট টেবিল। আর সাধারণ পালকিটির বাহ্যিক গড়ন ছিল আয়তাকার। দুদিকে দুই দরজার সঙ্গে ছিল ঢালু আকৃতির ছাদ। এরকম পালকিতে আবার দরজার পাশাপাশি জানালাও দেখা যেত।

ছবি: সংগৃহীত

Advertisement

তবে সবরকম পালকির গায়েই কারুকাজ করা থাকতো, হয় রংতুলির আঁচড়ে অথবা খোদাই করা কাঠে। কারুকাজগুলো পালকির শোভাবর্ধনের একপ্রকার চালিকাশক্তি রূপেই ব্যবহৃত হতো! ধর্মীয়, সভ্যতা-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনো পর্যায়টিতে পালকির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ চোখে পড়তো না?

পালকি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ পল্যঙ্ক বা পর্যঙ্ক থেকে উদ্ভূত। বাল্মীকি রচিত রামায়নে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে পালকির কথা জানা যায়। মায়া ও মিশরীয় সভ্যতার বহু চিত্রলিপিতে পালকির নিদর্শন মিলেছে। প্রাচীন বহু মন্দিরে মিলেছে দেবতাদের পালকিতে ভ্রমণ করা দৃশ্যের ভাষ্কর্য। আগেকার দিনে হিন্দুদের তীর্থযাত্রার এক অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো পালকি।

পালকির গায়ে খোদাই করা বা আঁকানো নকশাগুলো ছিল চারু ও কারু লোকজশিল্পের বৃহৎ ভান্ডার। শুধু কি তাই? পালকি বহন করার সময় বেহারারা আরও একটি চমৎকার কাজ করতেন! পথের ক্লান্তি তাড়ানোর রসদ হিসেবে ঠোঁট ও পায়ের আশ্চর্য এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করতেন! ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে পা ফেলতে ফেলতে সেই ছন্দ ও সুর ধরে শ্লোকের মতো গান গাইতেন।

যা তাদের অজান্তেই একটা সময় রূপ নেয় আমাদের লোকসাহিত্যের মূল্যবান এক রত্ন রূপে। একেবারে সাধারণ সৃষ্টিশীল আবহে দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোও পরম মর্যাদায় প্রাণ পেত সেই সব কল্পচিত্রায়িত গানের কথামালায়। সহজবোধ্যতা ও একাধারে নান্দনিকতার মাপকাঠিতে যা সবার হৃদয় ছুঁয়ে শক্ত ভীত গেড়েছিল প্রাণের গহীনে।

ছবি: সংগৃহীত

বিভিন্ন গান কবিতা বা উপন্যাসে বেহারা ও তাদের পালকির কথা কতবার কতভাবে যে উঠে এসেছে! কখনো মূল প্রতিপাদ্য বিষয়রূপে, কখনো কবির অলংকারিক ছান্দিক ব্যবহারে, কখনো বা কল্পনাপ্রসূত ভাবনার সংস্কারক কাঠামো হিসেবে। হোক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা কিংবা মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধুর মতো কালজয়ী উপন্যাসের গোছানো ভাবনার সৌন্দর্যবর্ধনের বহিঃপ্রকাশ, কখনো কণ্ঠশিল্পীর মধুমাখা কণ্ঠে আবার কখনো চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়ে। আজও মনে পড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানগুলো।

সে সময় মোঘল রাজবংশের রীতি অনুযায়ী নারীরা সম্রাটদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে পালকিতে চড়ে উপস্থিত থাকতেন। নিরাপদ দূরত্বে, পালকির ভেতর বসে তারা স্বচক্ষে যুদ্ধ দেখতেন। তখনকার দিনে স্বচ্ছল বা জমিদার শ্রেণির প্রত্যেকের আলাদা আলাদা করে নিজস্ব পালকির ব্যবস্থা থাকতো। পালকি বহনের জন্য থাকতো নির্দিষ্ট বেহারা। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও জন ম্যাগ্নোলিসহ আমাদের রবী ঠাকুরও কিন্তু নিজস্ব পালকি ব্যবহার করতেন। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আজও কবিগুরুর ব্যবহৃত পালকিটি সংরক্ষিত আছে।

রেলযোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ ও আভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ উন্মেষের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে গভর্নর জেনারেলও পালকি ব্যবহার করতেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে চালু হয়ে সেই শতকের শেষ অবধি ডাক এবং যাত্রী পরিবহনের জন্য ‘স্টেজ পালকি’ নামে একটি সেবার প্রচলন ঘটান তৎকালীন কোম্পানি সরকার।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কিছু সৌখিন, স্বচ্ছল পরিবার ব্যতিরেকে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে, বিশেষ করে ১৯৩০ এর সময়কালের রিকশা আবির্ভাবের পর পরই ইংরেজ হর্তাকর্তারা পালকির ব্যবহার একেবারে বন্ধ করে দিতে উদ্যত হন। এর মধ্যে পশুবাহী যান, রেল ও সড়ক যোগাযোগ পায় অন্য মাত্রা। যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে পালকির প্রয়োজনীয়তাও ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে।

তবে ১৯৪০ সালের দিকে অর্থাৎ উপমহাদেশে দাসপ্রথার বিলুপ্ত হবার পরপরই বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুরসহ মধ্যপ্রদেশ থেকে বহু সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত মানুষ এদেশে এসে শুষ্ক মৌসুমে বেহারার কাজ করতেন। বর্ষাকালে আবার নিজেদের অঞ্চলে ফিরে চলে যেতেন। পালকির সর্বাধিক গ্রহণ যোগ্যতা আরো একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে লক্ষ্যনীয় ছিল অবশ্য! পালকিতে চড়ে কনের বধূবেশে বরের বাড়িতে যাওয়ার দৃশ্য তখন হরহামেশাই প্রত্যক্ষ করা যেত। অসুস্থ এবং অথর্ব মানুষজনকে বৈদ্যশালা বা অন্য কোথাও বহন করে নিয়ে যাবার জন্যও পালকি ছিল অনস্বীকার্যভাবে গুরুত্বের দাবিদার।

ছোটবেলায় মেলা থেকে কিনে আনা খেলনা পালকি আর বইয়ের পাতায় মূদ্রিত বা অঙ্কিত পালকি দেখেই এই এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনুভব করতে চায়, স্পর্শ করতে চায় পালকিকে। শিশুকালেই পালকির সঙ্গে বাঙালি ছেলেপুলের যোগাযোগটা বইয়ের পাতায় প্রথমেই করিয়ে দেন রবিঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। বাঙালির এখনকার প্রজন্মটি এই কবিতা দুটো দিয়েই নিজ কল্পনা প্রসূত চিন্তায় পালকিতে থাকা মাকে রক্ষা করে চলে বীরপুরুষের মতো।

ছবি: সংগৃহীত

আবার হুনহুনা সুর তুলে পালকির গানে ছেলেবেলার তপ্ত গ্রীষ্ম দুপুর মুখরিত করে। একটা সময় চির বাংলাজুড়ে বেহারার ছান্দিক পদচারণায় মুখর, অনবদ্য এক বাহন আজ শোভা পাচ্ছে জাদুঘরে। বাংলার নিত্যদিনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা এক প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী বাহন এভাবেই কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। পালকিতে চড়ার সাধ শুধুমাত্র শ্রবণেন্দ্রিয়ের সুখের মতো অধরাই রয়ে গেছে।

তবে একটা কথা না বললেই নয়, পালকি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে উজ্জ্বলভাবে খচিত আছে এ কথা ঠিক হলেও, সে যুগে পালকিকে কম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। পথে যেতে যেতে ডাকাতদলেরর হানা, সর্বস্ব লুট, পালকিতে থাকা নারীদের ডাকাতদলের চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এগুলো যেন প্রায় রোজকার বিষয় হয়েই চোখে ধরা পড়তো।

যেহেতু গ্রামের পর গ্রাম পালকি বয়ে নিয়ে যেতে হতো আর লোকসংখ্যা ও বসতবাড়ির ঘনত্ব কম ছিল সে সময়, তাই মাঝে মাঝেই ডাকাতের কবলে পড়তে হতো পালকির যাত্রী ও বেহারাদের। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, ব্যক্তিগত অভিপ্রায় থেকে লক্ষ্য করা বিশ্লেষণ হলেও এটি একেবারে সত্য যে পালকি বহনকারী বেহারারা সে সময় অত পথ হেঁটে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতেন। গ্রামকে গ্রাম যাত্রী কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় নয়। এর জন্য অমানুষিক পরিশ্রম ও কষ্ট ছিল বেহারাদের নিত্যসঙ্গী।

এমআরএম/কেএসকে/জেআইএম