আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক জোটকে ঢেলে সাজাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ

কখনো কখনো বলা হয়, আমেরিকার মিত্র আছে আর চীন ও রাশিয়ার আছে কেবল গ্রাহক। অধিকাংশ দেশই দুটি শিবিরের মধ্যে অস্বস্তিকরভাবে ঘোরাফেরা করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জোট ও অংশীদারদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেটওয়ার্ক, বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় আমেরিকার ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ।’ এটি বাইডেনের পূর্বসূরি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে একটি বড় পরিবর্তন, যিনি বেশিরভাগ মিত্রকে সুবিধাবাদী হিসাবে বিবেচনা করতেন।

Advertisement

ইউরোপের কথাই ধরা যাক, ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে ইউক্রেনে সাহায্য পাঠাতে আমেরিকার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনও ন্যাটোতে যোগ দিতে ছোটাছুটি করছে।

এশিয়ায় চীনের আধিপত্য কমাতে আমেরিকার প্রচেষ্টা তার আনুষ্ঠানিক জোট ও উদীয়মান অংশীদারদের নেটওয়ার্কের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করছে। ২০২৩ সালে আমেরিকা পূর্ব ও পশ্চিমে তার মিত্রদের মধ্যে প্রতীকী অর্থে ‘সংযোগ টিস্যু’ (টিস্যু যা শরীরের অন্যান্য টিস্যু ও অঙ্গকে সমর্থন করে, রক্ষা করে এবং গঠন করে) আরও শক্তিশালী করতে চায়। একদিকে, জো বাইডেন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই সংযোগকে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে প্রতিযোগিতার অংশ হিসাবে দেখেন।

অপরদিকে, ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশকে একত্রে ইউরেশিয়া বলা হয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ এ অংশেই বসবাস করে। এই অঞ্চলকে ঘিরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক নিকোলাস জন স্পাইকম্যান ধারণা দেন রিমল্যান্ডের। রিমল্যান্ড হলো একটি ধারণা বা তত্ত্ব যা ভৌগলিক কারণে একটি দেশের নিরাপত্তা নীতির পরিকল্পনা। তিনি একটি দেশ বা মহাদেশের সমুদ্রসীমা বর্ণনা করেছেন, বিশেষ করে ইউরেশিয়া মহাদেশের পশ্চিম, দক্ষিণ এবং পূর্ব প্রান্তে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলকে ঘিরে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই ‘রিমল্যান্ড’ নিয়ন্ত্রণ করে ইউরেশীয় কেন্দ্রভূমিকে ধারণ করার পুরোনো ভূ-রাজনৈতিক ধারণা পুনরুজ্জীবিত করতে চান। যেখানে জাপান থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত মিত্রদের একটি জোট প্রসারিত।

Advertisement

কিন্তু ছোট ছোট টুকরোগুলোকে এক সঙ্গে সংযুক্ত করা এতো সহজ নয়। ন্যাটো পারস্পরিক প্রতিরক্ষার ওপর ভিত্তি করে গঠন করা হয়, যেখানে একজনের ওপর আক্রমণ মানেই সবার ওপর আক্রমণ। এর বিপরীতে এশিয়ায় আমেরিকার জোট হলো দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলোর একটি ‘হাব-অ্যান্ড-স্পোক’ ব্যবস্থা যেখানে পরিকল্পনা এবং প্রশিক্ষণ সামান্য ব্যাপার।

আমেরিকা অনানুষ্ঠানিক অংশীদারদের সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার সম্পর্ক আরও জোরালো করার চেষ্টা করছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরক্ষা অনুশীলন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়া এবং ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে সামুদ্রিক জলদস্যুতা রোধ করা পর্যন্ত সবকিছুতে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের সঙ্গে বহুমুখী কার্যক্রম চালিয়েছে কোয়াডের (চীনবিরোধী জোট হিসেবে পরিচিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে গঠিত কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) মাধ্যমে।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নতুন প্রবণতা ইউরোপীয়ান ও এশিয়ান মিত্রদের আরও সম্পৃক্ত করেছে। অকাস চুক্তি অনুযায়ী, পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরিতে অস্ট্রেলিয়াকে প্রযুক্তি সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা ও হাইপারসনিক মিসাইল সহযোগিতাও করবে তারা। যদিও এটি নিয়ে নাখোশ ফ্রান্স। কেননা, ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পূর্বের চুক্তি ভেসতে গেছে এতে। ইন্দো-প্যাসিফিকের মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিয়েছে। ২০২২ সালের জুনে মাদ্রিদে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছে তারা। ইউরোপীয় দেশগুলো প্রশান্ত মহাসাগরে কাজ করার জন্যও যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে।

বিশিষ্ট আমেরিকানরা দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের পাশাপাশি ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-কে ‘জি-১২’ এ প্রসারিত করতে চান। ইউক্রেনকে সাহায্য করার জন্য, পশ্চিমা অস্ত্রাগার পুনরুদ্ধার ও মিত্র বাহিনী গড়ে তোলার জন্য অস্ত্রের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ সামরিক সংগ্রহের বিষয়ে আরও সহযোগিতার বিষয়েও কথা বলা হচ্ছে।

Advertisement

অন্যদিকে, উদীয়মান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আইটুইউটু’। ইসরায়েল, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সংযুক্ত করে এ জোট। খাদ্য নিরাপত্তা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রযুক্তির বিকাশ তাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে আটকাতে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সখ্যতা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বলতাও আছে কিছু। এর একটি হলো তাইওয়ান ইস্যু। চীনের আক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা এখন তাইওয়ান। এখনও আমেরিকার অফিসিয়াল জোটের নেটওয়ার্কে সবচেয়ে কম সংহত এই অঞ্চল।

আরও একটি ফাঁক আছে যুক্তরাষ্ট্রের ভারতের সঙ্গে। এটি আমেরিকার কাছাকাছি থাকলেও এখনও রাশিয়ার সঙ্গে জোট নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী সামরিক সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে আছে। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ প্রীতি অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা রয়েছে। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ান অস্ত্রের দুর্বলতা, পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহে ভারতের স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করবে। আমেরিকার বন্ধুদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ করার জন্য একটি সামগ্রিক বাণিজ্য কৌশলের অভাব হলো সবচেয়ে গুরুতর দুর্বলতা। তা ছাড়া ‘বন্ধুত্বকে’ উৎসাহিত করার ব্যাপারও রয়েছে। বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে সংবেদনশীল সরবরাহ স্থানান্তর করাও গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি) প্রগতিশীল চুক্তি নামে পরিচিত একটি বাণিজ্য চুক্তিতে ফিরে আসার জন্য এশিয়ার দেশগুলো আমেরিকার জন্য দরজা খোলা রেখেছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তরাধিকার এবং বাইডেনের নিজস্ব সুরক্ষাবাদ এখনও শক্তিশালী।

চীন ও রাশিয়া নিজেদের ক্লাব গড়ে তুলছে। ইউরেশীয় গ্রুপ, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। বৃহৎ উদীয়মান অর্থনীতির একটি গ্রুপ ব্রিকসের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। জ্বালানির ঘাটতির সময়ে, উপসাগরীয় আরব তেল উৎপাদনকারীরা ওপেক প্লাস গ্রুপে রাশিয়ার সঙ্গে তেলের দাম উচ্চ রাখার সাধারণ কারণ তৈরি করেছে, যা আমেরিকাকে রাগান্বিত করছে।

বাইডেন বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের অংশে গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারে বিশ্বকে বিভাজনে সুর নরম করেছেন। আমেরিকা বলছে তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। তবে অনেক দেশই আশঙ্কা করছে বৃহৎ শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএনআর/জিকেএস