হাসমত আলীর পরিবারে সদস্য সংখ্যা পাঁচ। দুই পিচ্চি ছেলে, গৃহপরিচারিকা আর তারা স্বামী স্ত্রী দুজন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে একটা জনমত জরিপের আয়োজন করেছিলেন হাসমত আলী। দেখা গেলো, তার সমর্থিত দলের পক্ষে কেউ নেই। স্ত্রী হুসনা বানু যে নেই, এটা জানা ছিল আগে থেকেই। হাসমত আলী দুই ছেলের হাতে দুই প্যাকেট চিপস দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-: আমার প্রাণপ্রিয় আব্বা’স লিমিটেড কোম্পানি। রানিং বিশ্বকাপে কোন দল তোমাদের সাপোর্ট লাভ করছে, টেল মি। বড়টা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো-: খালামণির দল। ছোটটা উত্তর দেওয়ার আগে কিছুক্ষণ দোনামোনা করল। একবার তাকাল হাসমত আলীর দিকে; আবার তাকাল বড় ভাইয়ের দিকে। শেষে উদাস ভঙ্গিতে বলল- : আমিও। কাকা নামে একজন খেলোয়াড় আগের কোনো এক বিশ্বকাপে খেলেছিলেন। সাবেক সেই খেলোয়াড়ের দলকে কাকার দল বললে দোষের কিছু নেই। কিন্তু খালামণির দল? খালামণি নামে কোনো খেলোয়াড় দুবাই ফুটবল বিশ্বকাপে খেলছেন-এরকম কোনো তথ্য জানা নেই হাসমত আলীর।
Advertisement
তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্রীড়া ম্যাগাজিনের পাতা উলটপালট করে দেখলেন-তার ধারণা সঠিক; খালামণি নামের কোনো খেলোয়াড়ের অস্তিত্ব নেই। কিছুক্ষণ বাদে হুসনা বানুর বদন্যতায় পরিষ্কার হলো বিষয়টা। হুসনা বানু মারফত জানা গেলো, দুপুরে কদম বানু এসেছিল।
কদম বানু হচ্ছে হুসনা বানুর ছোট বোন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কদম বানু শামসুন্নাহার হলে থাকে। সে বোনের পুত্রদ্বয়কে মটিভেট করে তার প্রিয় দলের সাপোর্টার বানিয়ে গেছে। শেষ ভরসা গৃহপরিচারিকা। হাসমত আলী তার মনোভাব জানার চেষ্টা করতেই সে সোজা বলে দিল-: আমার কোনো দলবল নাই খালু। কথাটা বিশ্বাস করলেন না হাসমত আলী। তিনি বুঝতে পারলেন, এই বেটিকে এরইমধ্যে নিজের দলে ভিড়িয়ে ফেলেছে হুসনা বানু। এর প্রমাণও পাওয়া গেলো একদিন পর। অফিস থেকে ফিরে হাসমত আলী দেখলেন-হুসনা বানুর প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের রঙিন পোস্টার স্কচটেপ দিয়ে দেওয়ালে লাগানো আর ব্যালকনিতে পতপত করে উড়ছে সেই খেলোয়াড়দের মাতৃভূমির পতাকা। হাসমত আলী গৃহপরিচারিকাকে তলব করে জিজ্ঞেস করলেন-
: দেওয়ালে এই ছবি কে লাগাইছে?: আমি।: আর পতাকা কে আনছে?: আমি। : এই বাসায় কি শুধু তোমার খালাম্মাই থাকে, নাকি আমরাও থাকি? তুমি এই ছবির পাশে আমার দলের খেলোয়াড়দেরও দুইটা ছবি লাগাইয়া দিতা; আর পতাকা আনার সময় দুই দেশের দুইটা পতাকা আনলে ক্ষতি কি হইতো?হাসমত আলী পোশাক না পাল্টিয়েই ব্যালকনিতে উড়তে থাকা পতাকার মাপ নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। তারপর ওই পতাকার চেয়ে তিনগুণ বড় সাইজের পতাকা আর প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের গুটা দশেক পোস্টার কিনে বাসায় ফিরলেন। ব্যালকনিতে পতাকা উড়িয়ে আর দেওয়ালে, দরজায়-এমনকি ফ্রিজের গায়ে পোস্টারগুলো সেঁটে দিয়ে নাশতার টেবিলে বসলেন। পোস্টার আর পতাকা পর্বের পর শুরু হলো দান খয়রাত পর্ব। কয়েকদিন পর বাসায় ফেরার পথে গৃহপরিচারিকাকে রাস্তায় দেখে হাসমত আলী জানতে চাইলেন-
Advertisement
: কই গেছিলা!: ফকিররে খয়রাত দিতে।: সারাজীবন দেইখ্যা আইলাম-খয়রাত পাওয়ার জন্য ফকির হাজির হয় মানুষের দুয়ারে। আর তোমার বেলায় দেখতেছি উল্টা নিয়ম। তুমি ফকির খুঁইজ্যা খুঁইজ্যা খয়রাত করতেছো! বিষয় কী?: আইজ খালাম্মার দলের খেলা। দল যাতে জয়লাভ করে, সেইজন্য উনি দান-খয়রাত করতেছেন। হাসমত আলী আর কোনো কথা বললেন না। তবে ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে হুসনা বানুকে বললেন-
: আমি আগামীকাল কয়েকজন লোকেরে খাওয়ানোর নিয়ত করছি। তুমি কাইন্ডলি আয়োজন করো। পরদিন যারা খেতে এলো, তাদের দেখে হুসনা বানুর মাথায় হাত। তিনি ভেবেছিলেন, হাসমত আলী তার অফিসের সহকর্মী কিংবা বন্ধুদের দাওয়াত করেছেন। তাই বিশেষ যত্নসহকারে রান্নাবান্না করেছেন। কিন্তু খাওয়ার সময় দেখা গেলো, হাসমত আলী কয়েকজন ফকির ধরে এনেছেন রাস্তা থেকে।খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা শেষ হওয়ার পর স্বামীকে পাকড়াও করলেন হুসনা বানু। বললেন- : হঠাৎ ফকির খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়লো কীজন্য? হাসমত আলী স্ত্রীর সঙ্গে কোনোরকম বাহাসে লিপ্ত হলেন না। সংক্ষেপে বললেন-: মন চাইলো, তাই খাওয়াইলাম।
সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়ে দিলেন, পাশের মসজিদের ইমাম সাহেব হুজুরকে দাওয়াত করা হয়েছে। হুজুর মেহেরবানি করে দাওয়াত কবুল করেছেন এবং আজ বাদ এশা তিনি দাওয়াত খেতে আসবেন। পরম তৃপ্তি সহকারে ইমাম সাহেব হুজুরের ভোজন পর্ব সম্পন্ন হলো। এবার মোনাজাতের পালা। হাসমত আলীর কাছে মোনাজাতের বিষয় জানতে চাইলেন হুজুর। হাসমত আলী নিশ্চিত ছিলেন, তিনি কী বলেন-তা শোনার জন্য পাশের ঘর থেকে কান খাড়া করে আছে হুসনা বানু। তাই জোরে না বলে হুজুরের কানে কানে মোনাজাতের বিষয়স্তু বলে দিলেন। কিন্তু মোনাজাতের এক পর্যায়ে হুজুর আবেগের জোশে গলায় সুরের ঢেউ তুলে উচ্চস্বরে বলে ফেললেন-
: ইয়া মাবুদে এলাহী। ইয়া রাব্বুল আলামিন। জনাব হাসমত আলী সাহেবের মনোবাসনা তুমি পূরণ করে দাও। উনার প্রিয় দলকে তুমি ফাইনাল খেলায় সোনার মেডেল পাওয়ার তওফিক দাও মালিক... মোনাজাত শেষে হুজুরের গলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসমত আলী আমিন বললেন বটে; কিন্তু তার আত্মাটা ছ্যাৎ করে উঠল। হুজুর বাক্যচয়নে ভুল করেছেন। এই ভুল বাক্য যদি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়, তাহলে সাড়ে সর্বনাশ। ফাইনালে জয়ী দল মেডেল পাবে না, পাবে ট্রফি। হাসমত আলী আল্লাহপাকের দরবারে সংশোধনী দিয়ে মনে মনে বললেন-: পরোয়ারদিগার, কাইন্ডলি ইমাম সাব হুজুরের শেষ বাক্যটারে তুমি ‘স্লিপ অব টাঙ’ হিসেবে গণ্য করে ‘মেডেলের’ জায়গায় ট্রফি কাউন্ট করবা; এইটা আমার হাম্বল রিকোয়েস্ট। হুজুর বিদায় নেওয়ার পর হাসমত আলীর সামনে এসে দাঁড়ালো হুসনা বানু। তারপর চোখ ছোট করে বললো-
Advertisement
: তলে তলে এই ঘটনা? হাসমত আলী সহসা কোনো কথা বলতে পারলেন না। ধরা পড়ে গেছেন এই ভয়ে নয়; বরং হুসনা বানু তার প্রিয় দলের বিজয় কামনায় এখন যদি আরও বড় কোনো আয়োজনের ঘোষণা দেয়- সেই আশঙ্কায় নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।basantabilas2021@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এমএস