বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস শ্রম ও জনশক্তি হলেও কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশযাত্রা এতো সহজ নয়। পদে পদে বাধা ডিঙিয়ে আকাশে উড়তে হয় বিদেশগামীদের। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশগামীদের অন্যতম বাধা হচ্ছে জনশক্তি ও কর্মসংস্থান কার্যালয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া। সেকেলে সার্ভারে নেওয়া হয় বিদেশগামীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট। আর সেই পুরোনো সার্ভারেই দেশজুড়ে ভোগান্তির শিকার বিদেশগামীরা। তিন-চার দিন অপেক্ষার পরেও দেওয়া যাচ্ছে না ফিঙ্গারপ্রিন্ট। আর এই দুর্বল সার্ভারে আটকে যাচ্ছে অনেকের বিদেশযাত্রা।
Advertisement
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান কার্যালয়ে দেখা গেছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে আসা মানুষের ভোগান্তির চিত্র। এখানে অনেকে দুই থেকে পাঁচ দিন এসেও দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আগ্রাবাদের সিজিএ বিল্ডিং-২ এর নিচ তলায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে আসা মানুষের জটলা। সবাই শোরগোল করছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সার্ভার জটিলতার কারণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে পারছেন না তারা। আবার একই জটিলতায় অনলাইনে অনেকে রেজিস্ট্রেশনের টাকাও জমা করতে পারছেন না। এরমধ্যে অনেকের বিদেশযাত্রা ঘনিয়ে আসছে। অনেকে নির্ধারিত সময়ে বিদেশের গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে ভিসা বাতিলের শঙ্কাও রয়েছে। এতে লাখ লাখ টাকা ক্ষতির শিকার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ভুক্তভোগীদের।
গার্মেন্টস শ্রমিক স্বামীকে ওমান পাঠানোর জন্যে এনজিও থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন সাথী আকতার। এরই মধ্যে ওমানে যাওয়ার সব প্রক্রিয়া শেষে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে তিন দিন ঘুরে স্বামী ফেরত গেছেন গার্মেন্টেসের কর্মস্থলে। তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট কখন দিতে পারবেন, সেটি জানার জন্য কোলের শিশুকন্যাকে নিয়ে চট্টগ্রাম জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসে সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন তিনি।
Advertisement
সাথী আকতার জাগো নিউজকে বলেন, আমার স্বামী ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে তিন দিন ধরে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। তিনদিন ছুটি নিয়ে এসেছিলেন। আজ চাকরিতে চলে গেছেন। কখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট হবে সেটি জানার জন্য এসেছি।
তিনি বলেন, আমার স্বামী ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন। এনজিও থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি তাকে ওমান পাঠানোর জন্য। আগামী মাস থেকে ঋণের কিস্তিও শুরু হবে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট না হওয়ায় তার ওমান যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এখন আমি উভয় সংকটে পড়েছি।
হাটহাজারির বাসিন্দা রাকিব। তিনি গত এক সপ্তাহ ধরে ঘুরছেন চট্টগ্রাম জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসে। তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহে প্রতিদিন এখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে এসে ঘুরছি। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফেরত যেতে হচ্ছে। আমার ভিসার মেয়াদ আছে মাত্র ১৫ দিন। এখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিলে ক্লিয়ারেন্স আসতে ৬-৭ দিন লাগে। এখানে আমাকে এক সপ্তাহ ধরে হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ এখনো ফিঙ্গার দিতে পারিনি।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে এখানে নাকি সার্ভারে কাজ করছে না। জনশক্তি অফিস থেকে আমাকে প্রথমে বিকাশে পাঠানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখি বিকাশেও সার্ভারে কাজ করছে না। আবার বলছে সোনালী ব্যাংকে যেতে। সোনালী ব্যাংক থেকে ২২৩ টাকা দিয়ে পে স্লিপ নিয়ে এসেছি। এখন বলছে, পে স্লিপ ফেরত দিয়ে আসতে। আগ্রাবাদ মোড়ে সোনালী ব্যাংকে আসা-যাওয়া করতেও ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া লাগে। আমার মতো শত শত মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
Advertisement
ফটিকছড়ির বাসিন্দা শোয়েব আরমান ইংল্যান্ডের চাকরি ভিসা পেয়েছেন। তিনিও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে এসে দুদিন ধরে জনশক্তি অফিসে ঘুরছেন।
শোয়েব আরমান জাগো নিউজকে বলেন, আমি দুদিন ধরে এসে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারছি না। আমার রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বিকাশে ফি জমা দিতে পারছি না। রাতেও চেষ্টা করেছি, কিন্তু সার্ভারে অ্যান্ট্রি করা যাচ্ছে না। আমি ওয়ার্ক পারমিট ভিসা পেয়েছি। আমার জানুয়ারির মধ্যে ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে হবে। এখন আমার ম্যানপাওয়ার পাওয়া খুবই জরুরি। অথচ আমার পাসপোর্টসহ সব ডকুমেন্ট ভেরিফাই করে ইংল্যান্ড আমার ভিসা দিয়েছে। এখানে নাকি সার্ভার ফল্ট।
এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলীর মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন করেও তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া গেছে। পরে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের সহকারী পরিচালক মহেন্দ্রা চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, শুধু চট্টগ্রামে নয়, আমাদের প্রত্যেকটি অফিসেই সার্ভারে সমস্যা হচ্ছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। সার্ভার জটিলতার বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক জেলা ও আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তারা গ্রুপে (হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে) লিখেছে। এটি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখছেন। তারা সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক বাদেও সারাদেশে ৪২টি জেলা অফিস ও ১০টি টিটিসিতে (কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) বিদেশ গমনেচ্ছুরা রেজিস্ট্রেশন করেন। এরপর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়। পরে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স বা বহির্গমন পাস দেওয়া হয়। এই বহির্গমন পাসকে বিদেশগামীরা ‘ম্যান পাওয়ার’ হিসেবেই জানেন। প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারের মতো বিদেমগামী ম্যানপাওয়ারের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেন।
এ বিষয়ে জানতে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলমকে একাধিক ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলে মহাপরিচালকের দাপ্তরিক নম্বর থেকে ফিরতি ফোনে মহাপরিচালক দপ্তরের সহকারী পরিচালক রাহেনুর ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার জটিলতার নিয়ে গত সপ্তাহেও কোঅর্ডিনেশন মিটিংয়ে বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। জটিলতা দূর করতে সিস্টেম এনালিস্টসহ তাদের টিম নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আপাতত কয়েকদিন ধরে সার্ভার নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে অবগত। সেটির সমস্যা সমাধানে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাজ করছেন।
তিনি বলেন, আমাদের সার্ভার অনেক পুরনো। বর্তমানে সারাদেশে প্রতিদিন চার হাজারের বেশি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন তার চেয়েও বেশি হচ্ছে। এতে প্রতিদিন সার্ভারে আগের চেয়েও চাপ বাড়ছে। এজন্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সবাই একসাথে কাজ করছেন। তাছাড়া সার্ভার আপগ্রেডেশন নিয়েও একটি মিটিং হয়েছে। সার্ভার আপগ্রেডেশন করার প্রাথমিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
ইকবাল হোসেন/এমকেআর