উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘ধর্ম’ যে বড় ঢাল, এটা সন্দেহাতীত সত্য। ক্ষমতার রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসে বিভিন্ন কালপর্বে ধর্মকে পুঁজি করেছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বীজও বপন হয়েছে এ ভূ-খণ্ডে। যার চূড়ান্ত প্রতিফলন ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্ব। পরিণতিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আত্মপ্রতিষ্ঠা। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতালাভের প্রচেষ্টা বা ক্ষমতা ধরে রাখার লালসায় ধর্মকেই হাতিয়ার করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশও এ ধারা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বরং উত্তরোত্তর তা আরও প্রবল ও প্রকট রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাকেন্দ্রের দৌড়ে থাকা বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মাশ্রিত দলগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। কখনোবা অবলম্বনও করেছে।
Advertisement
দেশের বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভবিষ্যৎ ধারা কোন পথে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণে প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় কী, তরুণ প্রজন্ম কতটা প্রস্তুত, স্বাধীন দেশের নাগরিকদের কী-ইবা স্বপ্ন-প্রত্যাশা, এসব নিয়েই কথা বলেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, শিক্ষক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ ইতিহাসের শিক্ষকের মুখোমুখি হন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রাসেল মাহমুদ।
জাগো নিউজ: বিজয় দিবস এলে কোন বিষয়টি আপনার চোখে সর্বপ্রথম ভেসে ওঠে?
মুনতাসীর মামুন: বিজয় দিবস এলে মুক্তির কথাটি সর্বপ্রথম মনে পড়ে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আমরা যারা ছিলাম, আমরা যে কী অবর্ণনীয় কষ্টে ছিলাম সেটা যারা শরণার্থী হয়ে চলে গিয়েছিল এমনকি মুক্তিযুদ্ধ করতে যারা গিয়েছিল তারাও এ বিষয়টি বুঝতে পারবে না। অবরুদ্ধ দেশে ছিল প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। অন্যসময় কিন্তু এ বিষয়টি ছিল না। সুতরাং আমাদের কাছে বিজয় মানে সত্যিকারার্থেই বিজয়, আক্ষরিক অর্থেই বিজয়।
Advertisement
জাগো নিউজ: মুক্তিযুদ্ধ নাকি স্বাধীনতাযুদ্ধ- এ নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?
মুনতাসীর মামুন: পার্থক্য করলে করা যায়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধও বলি। এটা খুব ভুল কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- মুক্তি ব্যাপক অর্থে। অর্থাৎ খালি একটা ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়। সেজন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন। আমরা এজন্য এ যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধও বলি। সবকিছু থেকে মুক্তি পেয়েছি তাতো নয়, তারপরও মুক্তিযুদ্ধ বলি। কিন্তু কেউ যদি বলে স্বাধীনতাযুদ্ধ তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে, এমনটি আমি মনে করি না। কারণ, এটা তো স্বাধীনতাযুদ্ধও ছিল। বঙ্গবন্ধু কি বলেননি- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তবে মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু নাম রয়ে গেছে, এখনো তাই মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও রয়ে গেছে। অনেক কিছু থেকে মুক্তি পেয়েছি, অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাইনি। সেজন্যই আমরা এটাকে মুক্তিযুদ্ধ বলি।
মুক্তিযুদ্ধ নাকি স্বাধীনতাযুদ্ধ- এ ধরনের বিতর্ক এলে অর্থহীন জটিলতার সৃষ্টি করে। এর কোনো মানে হয় না। মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছে ব্যাপক অর্থে। আর সংকীর্ণ অর্থে বললে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে। অসুবিধার কী আছে, দুটিই সত্যি।
জাগো নিউজ: বিজয়ের পূর্ণ ফল কি আমরা পাচ্ছি? না পেলে কী কারণ?
Advertisement
মুনতাসীর মামুন: মুক্তিযুদ্ধ বা যে কোনো যুদ্ধ হলে সব ফল পাওয়া যায় না। এটি একটি বিমূর্ত ধারণা। কিছু উদ্দেশ্য সফল হয়। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- কিছু উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। পরবর্তীকালে আবার পিছিয়ে গেছে। এরপর শেখ হাসিনা এসেছেন, আরও কিছু উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টা বঙ্গবন্ধু যেটা চেয়েছেন একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমরা এ লক্ষ্যটা সম্পূর্ণভাবে অর্জন করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তখন এটা স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র হবে। সেটা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছি। এর একটা মূল কারণ, স্বাধীনতাত্তোর যারাই সরকারে এসেছেন তারাই ধর্মাশ্রিত, ধর্মান্ধ এবং সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। যেটি আমাদের ক্ষতি করেছে, আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে তরুণদের সচেতন হতে হবে। তরুণরা চাইলে সব সম্ভব। বঙ্গবন্ধু তরুণদের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। তরুণরাই স্বাধীনতা চেয়েছিল, যুদ্ধ করেছিল, বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।
জাগো নিউজ: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার বিজয়ের ৫১ বছরে কতটুকু অর্জিত হয়েছে? এসব অর্জনের পথে বাধাসমূহ কী?
মুনতাসীর মামুন: এগুলো সরকার জানে, আমাদের কিছু জানার নেই। এ জিনিসটা পরিষ্কার হতে হবে। একটাই উত্তর- এসব প্রশ্ন সরকারের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের করতে হবে, আমাকে করে লাভ নেই। আমরা সরকারের পরামর্শক নই, আমরা বললে সরকার গ্রাহ্য করবে সেটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। সরকার সরকারের মতো চলে।
জাগো নিউজ: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচার কার্যক্রম এখনো চলছে। এরই মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ কার্যকরও হয়েছে। রাজাকারের তালিকা ও বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে কী বলবেন?
মুনতাসীর মামুন: আমরা সবসময় বলেছি সরকার যদি না চায় আমাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। আমরা বলেছি, ৫০ বছর হয়েছে রাজাকারের তালিকা করার জন্য। সরকার করবে না। তবে কি আমি করবো রাজাকারের তালিকা? আমার বিরুদ্ধে মুন্নুজান সুফিয়ান (বর্তমান সরকারের শ্রম প্রতিমন্ত্রী) মামলা করেছেন। এরকম ১০ জন মামলা করবে, সরকার আমার পক্ষে থাকবে?
জাগো নিউজ: গবেষকদের অনেকে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে গবেষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মৌলিক গবেষণার অভাবের বিষয়টি বারবারই আলোচনায় ওঠে আসে। যদি এমনটাই হয় তবে আগামী প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস জানবে কী করে?
মুনতাসীর মামুন: এটা ভুল ধারণা। ইতিহাস বিকৃত হবে, বিচ্ছুত হবে, হতেই পারে। কিন্তু সঠিক ইতিহাসও লেখা হচ্ছে। মূলকথা হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা সরকার এখনো করতে পারেনি। পৃথিবীর সব দেশেই জাতীয় ইতিহাস পড়তে হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে, কলেজ পর্যায়ে, এমনকি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও পড়তে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা নেই। যতদিন এদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় ইতিহাস পড়ানো হবে না ততদিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে প্রশ্ন করা অবান্তর।
জাগো নিউজ: বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব এবং দেশের রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে দেশের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম দিচ্ছে। এর দায় আসলে কার?
মুনতাসীর মামুন: এ দায় কারোরই নয়। এখন উন্মুক্ত প্রযুক্তি। টেলিভিশন বন্ধ করে দিলে ফেসবুক তারা দেখে না! দেখে তো। তাহলে ফেসবুক বন্ধ করে দেবে? এগুলো অবান্তর। যদি রাজনৈতিকভাবে বর্তমান প্রজন্ম সচেতন না হয় তবে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন হবে আলু-পটল, তরকারির মতো। রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হলে তারা দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে। তরুণরা ঘরে বসে থাকবে আর উপদেশ দেবে তা তো হবে না।
জাগো নিউজ: তরুণ সমাজকে সঠিক পথে ফেরাতে কী করণীয়?
মুনতাসীর মামুন: জনমত সৃষ্টি করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে। আমরা তো তা-ই করে আসছি। (ভার্চুয়াল মাধ্যমে) ঘরে বসে এ ধরনের উপদেশ দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
জাগো নিউজ: এবারের বিজয় দিবসে একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে আপনার প্রত্যাশা কী?
মুনতাসীর মামুন: আমার আসলে কোনো প্রত্যাশা নেই। আমরা জীবনের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল, আলাদাভাবে একটা মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ হবে। মুক্তিযোদ্ধা দুজন মন্ত্রীকে সেটা বলেও ছিলাম। তারা এ বিষয়টিতে কোনো গুরুত্ব দেননি। গবেষকরাও গুরুত্ব দেয়নি। ফলে যা হওয়ার কথা সেটা হয়নি। আমি শুধু চাচ্ছি একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। নিদেনপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ না হলেও অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ-রাষ্ট্র। এটাই আমি প্রত্যাশা করি। সেটা না হলে এই হতাশা থেকেই যাবে।
জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মুনতাসীর মামুন: আপনাকে এবং জাগো নিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
আরএসএম/এমকেআর/এএসএম