সাইফুর রহমান তুহিন
Advertisement
পাহাড়, নদী ও প্রাকৃতিক লেক দিয়ে ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি যেখানে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির মোট ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় আছে বিস্তৃত বনভূমি, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম লেক, জলপ্রপাতসমূহ, গুহাসমূহ ও ১৪টি ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী সম্প্রদায়।
রাঙামাটি বছরের একেক সময় প্রকৃতি একেক রূপ ধারণ করে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে। শীতকালে কুয়াশা ঘেরা পাহাড় আর বর্ষাকালে অনুপম ছন্দে লেকের ওপর বৃষ্টিপাত সবকিছুই দেশ-বিদেশের পর্যটকদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
Advertisement
এই লেখায় ভ্রমণপিপাসু পাঠকদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে-
রাঙামাটি
পাহাড়ি শহর রাঙামাটিজুড়ে কেবলই সবুজ পাহাড় আর নীল লেকসমূহ। তবে এখানে বেড়াতে যাওয়ার আগে পরিকল্পনা করুন, যাতে ভ্রমণকে আরও বেশি উপভোগ্য ও স্মরণীয় করে তুলতে পারেন।
রাঙামাটি শহরে দেখার মতো মনোমুগ্ধকর অনেক স্পট আছে। আপনি দিনব্যাপী ভ্রমণে যেতে পারবেন পলওয়েল পার্ক, আরণ্যক হলিডে রিসোর্ট, ঝুলন্ত ব্রিজ, আদিবাসী জাদুঘর, রাজবন বিহার, চাকমা রাজবাড়ি, আনন্দ বিহার, ডিসি বাংলো পার্ক, শহীদ মিনার চত্ত্বর ও কাপ্তাই লেকে।
Advertisement
চাইলে রাঙামাটিতে আরেকটি দিন কাটাতে পারবেন নৌকা কিংবা জলযানে চড়ে। নৌকা পাওয়া যাবে শহরের ফিশারীঘাট, ঝুলন্ত ব্রিজ, রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি ঘাট, রাজবাড়ি ও শিল্পকলা ঘাটে। সাইজের ওপর নির্ভর করে এগুলোর ভাড়া ১২০০-২৫০০ টাকা হতে পারে।
সকালবেলা আপনার যাত্রা শুরু করে দেখতে যেতে পারেন বুড়িঘাটে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আবদুর রউফ স্মৃতিস্তম্ভ এবং শুভলং জলপ্রপাত। লেকের আশপাশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে ওি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে খেতে পারবেন পছন্দের আইটেম।
প্রমোদিনী, স্বপ্নডিঙ্গা, মাওরুম ও রাঙ্গাতরীর মতো হাউসবোটও পাওয়া যাবে সেখানে ও এগুলোতে আপনি পাবেন লেকে রাত্রিযাপন ও পুরোপুরি প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজেকে মগ্ন করার সুযোগ।
বান্দরবান
পার্বত্য বান্দরবান হচ্ছে এমন একটি জেলা যা অসংখ্য জলপ্রপাত, গগণচুম্বী পাহাড় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আদিবাসী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। আর এসবের টানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে এলাকাটিতে।
এখানকার বন্য ও সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবসময় অন্যরকম এক আবেদন সৃষ্টি করে পর্যটকদের মনে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী অনেক পর্যটকই পায়ে হেঁটে দেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডাং ও তাজিনডংয়ের চূড়ায় ওঠার অভিযানে নামেন।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটির উচ্চতা আনুমানিক ২ হাজার ফুট। ৫০ টাকা প্রবেশ ফি’র বিনিময়ে এটি সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।
খোলা জিপ কিংবা সিএনজি অটোরিকশায় করে যেতে পারবেন নীলাচলে। বান্দরবান-কেরাণীহাট সড়কের পাশে অবস্থিত আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র মেঘলা। এখানকার মূল আকর্ষণ হলো দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত ব্রিজ। কেবল কার ও প্যাডেল বোটেও চড়তে পারবেন এখানে।
এটিও পঞ্চাশ টাকা প্রবেশ ফি’র বিনিময়ে সকাল আটটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত উন্মুক্ত। বান্দরবান শহর থেকে মেঘলায় যাওয়ার জন্য মাইক্রোবাস, খোলা জিপ ও সিএনজি পাবেন।
বান্দরবান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে রুমা-থানচি সড়কের পাশে অবস্থিত শৈল প্রপাত যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমীর জন্য অবশ্যই দেখার মতো জায়গা। স্থানীয় প্রশাসন এটির দেখাশোনা করে ও এটি দেখা যাবে নিখরচায়।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি সড়কের ওপর অবস্থিত চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ এর উচ্চতা ২ হাজার ৬০০ ফুট এবং এখানে মেঘের ওড়াওড়ি দেখতে পাবেন।
এটি পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নীলগিরি থেকে চিম্বুক পাহাড়ে যাবার পথে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
বাংলাদেশের উচ্চতম ও আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর একটি হলো নীলগিরি। বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি রোডে অবস্থিত নীলগিরি বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে। ক্যাম্পফায়ার করার জন্য জায়গাটি খুবই উপযোগী।
নীলগিরির একেবারে চূড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্মিত রিসোর্ট, কটেজ ও তাঁবু আছে। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরিতে যেতে হলে থানচিগামী বাস কিংবা জিপে চড়তে হবে। রোয়াংছড়ি উপজেলায় সম্প্রতি আবিষ্কৃত দেবতাখুম একটি সরু গিরিখাত।
এখানে পর্যটকরা উপভোগ করতে পারবেন বাঁশের ভেলায় করে পানির ওপর দিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চ। বান্দরবান জেলা শহর থেকে খোলা জিপ অথবা সিএনজিতে করে যেতে পারবেন দেবতাখুমে।
সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভ্রমণ করলে দেখতে পাবেন প্রাকৃতিক সব বিশাল বিশাল পাথর। স্থানীয় খুমি, টিপরা ও মারমা আদিবাসীদের জীবনযাত্রাও দেখতে পারবেন এখানে।
নাফাখুম জলপ্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে থানচি উপজেলা সদর থেকে দুই ইঞ্জিনের নৌকায় করে রেমাক্রি বাজারে যেতে হবে আপনাকে। রেমাক্রি থেকে আড়াই ঘন্টা হেঁটে তবেই পৌঁছবেন নাফাখুমে।
তবে বর্ষাকালে রেমাক্রি বাজার থেকে সরাসরি ইঞ্জিন বোটে করে যেতে পারবেন সেখানে। বান্দরবানের আরেকটি প্রাকৃতিক বিস্ময় হলো বগা লেক। জেলা শহর থেকে এটির দূরত্ব প্রায় ৬৩ কিলোমিটার। শুধু খোলা জিপে করেই যাওয়া যাবে বগা লেকে।
লেকটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। বম সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাত্রা দেখার সুযোগ মিলবে এখানে। বাংলাদেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডাং বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
রুমা বাজার থেকে খোলা জিপে করে যাওয়া যাবে কেওক্রাডাংয়ে। তবে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পর্যটকরা বগা লেক থেকে কেওক্রাডাং চূড়া পর্যন্ত ট্রেকিং করে থাকেন। বগা লেক থেকে কেওক্রাডাং চূড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারের ট্রেকিংয়ে পাবেন অনেক উচ্চতায় হাঁটার রোমাঞ্চ।
খাগড়াছড়ি
খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্রগুলো বছরজুড়েই পরিপূর্ণ থাকে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়ে। সবুজ পাহাড় ও সাদা মেঘের নজরকাড়া সৌন্দর্য ও রিসাং জলপ্রপাতের ঝিরিঝিরি শব্দ এখানকার প্রধান আকর্ষণ। রহস্যময় আলুটিলা সুড়ঙ্গপথও পর্যটকদেরকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।
খাগড়াছড়ির আলুটিলা ট্যুরিস্ট পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য যেখানে আছে আকর্ষণীয় সেতুসমূহ, উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ, তোরণসমূহ প্রভৃতি। বছর দুয়েক আগে জেলা প্রশাসন সাত কোটি টাকা ব্যয়ে পার্কটি প্রতিষ্ঠা করে।
উপরোক্ত দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার কারণে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র পরিণত হয়েছে বাড়তি একটি দর্শনীয় স্থানে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক আশা করছেন যে, এখানে পর্যটনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য ভবিষ্যতে আরো জোরদার হবে।
৫০০ আসনবিশিষ্ট উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চটি নির্মিত হয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য। পর্যটকরা এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি উপভোগ করতে পারবেন।
খাগড়াছড়িতে আরও যেসব নজরকাড়া দর্শনীয় স্থান আছে সেগুলো হলো- জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক, ঝুলন্ত সেতু, তারেং পাহাড়, মায়াবিনী লেক প্রভৃতি। প্রকৃতির অপরূপ বিস্ময় দিয়ে এগুলো পর্যটকদেরকে নির্মল বিনোদন দিয়ে থাকে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও ফিচার লেখক।
জেএমএস/জেআইএম