বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবময় অর্জনের দিন বিজয় দিবস। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় রচিত হয়। হাজার বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলো।
Advertisement
এ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় এক সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ।
অস্থায়ী সরকারের অধীনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এদেশের মানুষ। দীর্ঘ ৯ মাসের ২৬৬টি মহার্ঘ্য দিনের মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯১,৬৩৪ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের গৌরবের বাংলাদেশ।
বিজয় দিবস জাতীয় জীবনে অপরিসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্য্যমণ্ডিত। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে দিনটিকে বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় ও সরকারিভাবে দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সে থেকেই বিশেষ দিন হিসেবে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বত্র পালন করা হয় বিজয় দিবস।
Advertisement
প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে তো বটেই, এখন বিদেশেও বিশেষভাবে পালিত হয় দিনটি। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা ঘটে। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চৌকস সদস্যরা মহড়ায় যোগ দেন।
সুদৃশ্য কুচকাওয়াজের অংশ হিসেবে সালাম গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী। এই কুচকাওয়াজ দেখার জন্য প্রচুর সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে ঘরে বসে, অনলাইনে, টিভিতে সরাসরি কুচকাওয়াজ প্রদর্শনী দেখতে পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবে ঢাকার সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
বিজয় দিবস কেবল উদযাপন নয়। বিজয়ের কিছু নেপথ্য কথা প্রজন্মের জানা থাকা জরুরি। খুব বেশিদিনের কথা নয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে উপমহাদেশের জনগণ পায় পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি ভূ-খণ্ড রাষ্ট্র।
Advertisement
আমাদের ভূ-খণ্ড বাংলাদেশ ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের আগ পর্যন্ত ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা এদেশের বাঙালিদের শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার নিরন্তর ষড়যন্ত্র চালায়। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই এই ভূ-খণ্ড বঙ্গবন্ধু ক্রমাগত জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, অধিকার আদায়ের পথ দেখিয়েছেন।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে গণতান্ত্রিক জয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে।
বাঙালি অনিয়ম বৈষম্য সহ্য করে না। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি হানাদারদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি।
বাঙালি জাতি নতুন করে জানান দেয়, কাদামাটির মতো কোমল হৃদয়ের মানুষগুলো নিজেদের অধিকার আদায়ের বেলায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো হুঙ্কার দিতেও সক্ষম। ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এ আন্দোলন-সংগ্রাম ১৯৭১ এর মার্চে এসে স্ফুলিঙ্গে রূপ নেয়।
৭ই মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তর্জনীর তীর উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা’। মন্ত্রের মতো রাজনীতির এই কাব্যবাণী এবং বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর তীর, গোটা জাতিকে বিজয়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করে তুলে। সেই থেকে শুরু।
গবেষকরা বলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার আড়ালে সময় ক্ষেপণ করে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো।’
এদিকে পাকিস্তানি জান্তারা বাঙালির এ স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ভেতরে ভেতরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুরু হয়ে যায় বর্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বাঙালি নিধন অভিযান বা হত্যাযজ্ঞ। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার- আল-বদর মিলে ঢাকাসহ সারাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের বর্বরোচিতভাবে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে।
রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক সাজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বাঙালির জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালির মতোই দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্ণনা মতে, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছিল এ বাড়িটি। রাত ১২:৩০ মিনিটে আব্বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন।’
আর সেই খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্রগ্রামে পৌঁছে দেওয়া হলো পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। সেই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা তা প্রচার শুরু করেন। যে মুহুর্তে এই খবর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে পৌঁছলো, তারা আক্রমণ করলো এই বাড়িটিকে।
রাত দেড়টায় এসে আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আজও মনে পড়ে সেই স্মৃতি। লাইব্রেরি ঘরের দক্ষিণের যে দরজা, তারই পাশে টেলিফোন সেট ছিল। ওই জায়গায় দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ (স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার: শেখ হাসিনা।)
ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ডাক দেন। বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি।’
‘পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ একই সঙ্গে তিনি বার্তা পাঠান, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে ও শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি।’
‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান।’
‘কোন আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’ (সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড। তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২ সাল।)
উল্লেখ্য, ঘোষণাটি তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ অনেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের জন্য পুন:পাঠ করেছেন।
গবেষকদের মতে, পাকিস্তানীদের মূল লক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সব সচেতন নাগরিককে নির্মূল করা। কিন্তু তা কী হয়? পাকিস্তানের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার সর্বস্তরের মানুষ।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সর্বস্তরের জনগণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতে হাতে তুলে নেন অন্ত্র।
শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বিজয়ের জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ে দীপ্ত বাঙালি প্রজন্মের সামনে তখন কোনো মারণাস্ত্রই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালি হয়ে ওঠে সংগ্রাম-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারীদের প্রতীক।
এই ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছায়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তির অবস্থান প্রকাশ্যে চলে আসে। আগে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে এবং রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়ন) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়।
কিন্তু ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ জাহাজ পাঠানোর ঘোষণা দেয়। এছাড়া আগে থেকেই ভারত সার্বিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায় ও সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্র ভারত সরকার শরণার্থী আশ্রয়, খাদ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সহযোগিতা দিয়েছে। ওদিকে আগে থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ নেয় চীন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব আনতে তাতে ভেটো দেয় রাশিয়া। এতে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত আরও জোরালো হয়ে উঠে।
অবশেষে এক পর্যায়ে বাঙালির বীরত্বের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনী। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে লাখো বাঙালির প্রাণের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় বাহিনী) যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের পরাজয়ে উদিত হয় একটি নতুন দেশের সূর্য্য। সূচিত হয় নতুন ইতিহাস। পতপত করে উড়ে লাল সবুজের নতুন পতাকা। নতুন জাতীয় সঙ্গীত- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি..। বাঙালি জাতি পায় বীরের খেতাব। বিশ্বে হয়ে উঠে অনন্য বাংলাদেশ।
বিজয় মানে, হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে, আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি। বিজয় মানে কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের গৌরবগাঁথা। এই বিজয় অর্জনে অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত বাঙালি জাতির সামনে আলোকময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাই বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করলেই চোখে ভাসে রেসকোর্স ময়দান বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনী উঁচানো ছবি। তর্জনী উঁচিয়ে রেসকোর্সের ময়দানে বাঙালিকে নিবেদন করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর কাব্যিক নির্দেশনা আর জাদুর তর্জনীর তীর বাস্তবিক অর্থেই ছিলো ত্রুটি-বিচ্যুতিহীন নি:খাদ। এতেই কোটি কোটি মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। তার নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় এই বিজয়।
গবেষকরা বলেন, ‘১৯৭১ সালের আগে কিংবা পরে বাঙালির জীবনে এমন মুহুর্ত আর কখনো আসেনি, যখন পুরো জাতি অভিন্ন লক্ষ্যে এতোটা দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রধান কারণই ছিলো সমগ্র জাতির ইস্পাতকঠিন ঐক্য।’
বঙ্গবন্ধু ও বিজয় তাই একই সূত্রে গাঁথা। বাংলার মানুষকে বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, জাতীয় সংগীত, সংবিধান এবং বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয়। বিজয়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তরুণ প্রজন্মের হৃদয় ও মননে ধারণ করতে হবে।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যেনো আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আসে, সেজন্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর তীরে অর্জিত বিজয়ের মূলমন্ত্র চিরদিন প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রেরণা জোগাক- নির্ভীক যোদ্ধা হওয়ার। দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদিত রাখার।
লেখক ও গবেষক: এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জেএমএস/জেআইএম