জাগো জবস

বিজয় দিবস নিয়ে বিসিএস ক্যাডারদের ভাবনা

১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস, শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মর্যাদা লাভ করে। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য আনন্দ ও গর্বের। একইসাথে দুঃখের। কারণ ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, অসংখ্য নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এ অর্জন আমাদের।

Advertisement

দিবসটির মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে ও বিশ্বকে বারবার মনে করিয়ে দিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, শহীদদের কথা। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন দেশের তরুণ সমাজ। তাই বিজয় দিবসে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিভিন্ন জেলায় কর্মরত সহকারী কমিশনার এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারদের ভাবনা তুলে ধরেছেন ইসমাম হোসাইন—

পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির স্বাদ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাঙালি জাতির জীবনে বহু কাঙ্ক্ষিত একটি দিন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের অধীনতা থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক জাতিসত্তার বিকাশ ঘটে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধের এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে কৃষক, শ্রমিক, জনতা, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কবি, সামরিক-বেসামরিক সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। তৎকালীন মুজিবনগর তথা প্রবাসী সরকার পরিচালনায় সিভিল সার্ভিস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধকে একটি কাঠামো দিতে কাজ করে বেসামরিক প্রশাসন। তারই ধারাবাহিকতায় ‘জনসেবায় জনপ্রশাসন’ ব্রত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস।

Advertisement

স্বাধীনতার ৫১ বছরে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির হিসেব নেহায়েত কম নয়। স্বাধীনতার ৫১ বছরে আমরা যে রূপরেখা ঘোষণা করছি; সেটি বাস্তবায়নে নানা মেগা প্রকল্প, এসডিজি, ভিশন-২০৪১, ডেল্টা প্ল্যানসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে ২০৪১ সালের আগেই আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, বাণিজ্য, অর্থনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, দারিদ্র্য হ্রাস, গড়আয়ু, ইপিআই, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যু হার হ্রাস, জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার ই-নথি, ই-টেন্ডার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। এগুলোর পূর্ণ সুফল পেতে আমাদের আরও কিছু সময় প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে নাগরিক সেবা প্রদান, ঘরে ঘরে শতভাগ ডিজিটাল সেবা প্রদান, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনো আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে আমরা আজ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, সবার জন্য স্যানিটেশন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও আমরা কিছুটা ধীরগতিতে হলেও এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা দিতে না পারলে, দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত না করতে পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। সবার জন্য সুস্বাস্থ্য, সুস্থ বিনোদন, ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।

কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমাদের দুঃখ জমা দিব যৌথ খামারে।’ লাখো শহীদের রক্ত ও লাখো নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই পতাকার কাছে আমরা নতুন প্রজন্ম ঋণী। সেই ঋণ শোধ করতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাবো। আমাদের প্রজন্মের হাত দিয়েই ধরা দেবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

মহান বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের দীপ্ত শপথ। বঙ্গবন্ধুর তৈরি যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার শপথে স্বাধীন হয়েছিল প্রিয় দেশ, সেই মহান আদর্শ সমুন্নত থাক। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ হবে এক দীপ্ত অহংকারের নাম। জয় বাংলা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

তারেক রহমান, সহকারী কমিশনার এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বাগেরহাট।

Advertisement

****

বিজয় দিবস পালন হোক যথাযোগ্য মর্যাদায়

ছোট্ট শিশু থেকে আজকের এ বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বদলে গেছে চিরচেনা আশপাশ, তবু সেই একই আবেদন নিয়ে প্রতিবছর হাজির হয় ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবস। দিনটি বড় আবেগের, চেতনার ক্যানভাসে নতুন সব রঙের আচড় দিতেই যেন প্রতি বছর ঘুরে আসে এই মহান দিন। ছোটবেলায় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম উপজেলা মাঠে। যেখানে দিনভর বিভিন্ন বাহিনী ও স্কুল-কলেজের ভাইয়া ও আপুদের পিটি, কুচকাওয়াজ, ডিসপ্লে অনুষ্ঠিত হতো মহা সমারহে। আমার দেশপ্রেমের ভিত গড়ে দিয়েছে এ দিনটি।

ছোট্ট সেই বালক আমার কাছে দেশপ্রেম মানেই ছিল সাবিনা ইয়াসমিনের ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ কিংবা ফরিদা পারভীনের ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানের ডিসপ্লে। আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই, উপলব্ধি করি, আজ দেশের প্রতি আমার যে ভালোবাসা ও মমত্ববোধ কাজ করে; তার পেছনে রয়েছে জাতীয় দিবসগুলো যথাযথভাবে পালন করা। তাই আমি দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যদি আমরা আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে পৌঁছে দিতে চাই, তবে অবশ্যই বিজয় দিবসকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার কোনো বিকল্প নেই।

মো. জিয়াউল হাসান সৌরভ, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটজেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পটুয়াখালী।

****

স্বপ্ন আজ বাস্তব হতে শুরু করেছে

মহান বিজয় দিবস প্রাপ্তি ও হারানোর মহামিলনের দিন। এই দিনের স্বপ্নে যারা শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, এখনো আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন; তারা ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে একেকটি ইতিহাস হয়ে গেছেন। আজকের দিনে তাদের সশ্রদ্ধ সালাম। মহান বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী পালন করছি আমরা। এ সময়ের মধ্যে আমাদের অর্জন অভূতপূর্ব। যে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস নিয়ে ১৯৭১ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের পূর্বপুরুষগণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন; সে স্বপ্ন আজ বাস্তব হতে শুরু করেছে।

আমরা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। যোগাযোগ, কৃষি ও শিল্পের বিশাল অগ্রগতি অনস্বীকার্য। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ‘দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এক শিরোনামে লিখেছে, ‘What can Biden’s plan can do for poverty? Look to Bangladesh.’ নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘Socio-economic progress: Bangladesh example for other countries.’ মাথাপিছু আয়ে অনেক আগেই আমরা পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছি। সম্প্রতি ভারতকেও ছাড়িয়েছি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘২০৩৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে।’

আমরা আজ স্বাধীন দেশ বলেই কেবল এতসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। আমরা এখন এক ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে আমাদের বিসিএস ক্যাডারদের অসামান্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে। স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসের আবহে, দেশপ্রেমের চেতনায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, দেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিবেদিত মনোভাব নিয়ে চলুন আমরা সবাই কাজ করি একসাথে। গড়ে তুলি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

সাদরুল আলম সিয়াম, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, গাইবান্ধা।

****

সম্ভাবনাময় জাগ্রত জনতার শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশ

কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘আমার ছিল না মুক্ত মাতৃভূমি, শৃঙ্খলহীন স্বাধীন দেশ, শতবর্ষের শত সাধনায়, পেয়েছি তোমায় বাংলাদেশ।’ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দক্ষ নেতৃত্বের ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি অর্জন করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। বাঙালি জাতির লাল-সবুজের পতাকা স্থান পায় বিশ্ব দরবারে।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ভাষায়, ‘তোমাদের হাড়গুলো বাংলার হৃদপিণ্ডে অবিনাশী ঝড়, বাঙালির জন্মতিথি, রক্ত লেখা ১৬ ডিসেম্বর।’ এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেইসব বীর যোদ্ধাকে; যাদের মহান আত্মবলিদানের ফলে পেয়েছি লাল-সবুজের এই সোনার বাংলা। দেশপ্রেম শুধু বিজয় দিবসে আবদ্ধ না রেখে প্রাত্যহিক জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিজয়ের প্রেরণা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলি একটি সম্ভাবনাময় জাগ্রত জনতার শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশ।

সর্বোপরি, তরুণ প্রজন্মের উচিত লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

শামসুল আলম, সহকারী পুলিশ সুপারপুলিশ হেডকোয়ার্টার, ঢাকা।

এসইউ/জেআইএম