খেলাধুলা

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেই প্রমাণ হয়ে গেলো মেসিই সর্বকালের সেরা

 

মাঝ মাঠে ডানপ্রান্তে বলটির নিয়ন্ত্রন নিলেন। এরপর একটানে নিয়ে চললেন ক্রোয়েশিয়ার বক্সের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামানোর জন্য দৌড়াচ্ছেন জসকো জিভার্ডিওল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ডি বক্স পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন মেসিকে থামানোর। পারলেন না।

Advertisement

বক্সের কাছে জুটলেন আরও এক ডিফেন্ডার। অসাধারণ স্কিল, বডি ডজ আর ড্রিবলিংয়ের সমাহার দেখা গেলো এ সময় তার কাছ থেকে। একেবারে কর্ণার লাইনে বল নিয়ে গেলেন। এরপর বলটাকে আলতো করে ঠেলে দিলেন গোলমুখে। সেখানে যেন আগে থেকেই ওঁতপেতে দাঁড়িয়েছিলেন হুলিয়ান আলভারেজ। বলটি পেয়েই তিনি আরেকটু ছোঁয়া লাগালেন, বল সোজা জড়িয়ে গেলো ক্রোয়েশিয়ার জালে। দলটির বিখ্যাত হয়ে ওঠা গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচের চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তখন।

নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন, কার কথা বলা হচ্ছে। ঠিকই ধরেছেন। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৬৯তম মিনিটে অতিমানবীয়, অসাধারণ গোলটি এসেছে তো তার অসাধারণ অ্যাসিস্ট থেকেই।

মেসির ওপর ওই সময় যেন ভর করেছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। ৩৬ বছর আগে এমনি এক ম্যাচেই তো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একক প্রচেষ্টায় একটি গোল করেছিলেন ফুটবল সম্রাট ম্যারাডোনা। গোল অব দ্য সেঞ্চুরি আখ্যা দেয়া হয়েছে যাকে। তার আগেই ‘হাত দিয়ে’ বিতর্কিত গোলটি দিয়েছিলেন; কিন্তু পরের গোলটি দিয়েই সব বিতর্ক যেন মুছে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।

Advertisement

এবারও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে যেন মেসির রূপেই ম্যারাডোনা এসেছিলেন লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলার জন্য। ক্রোয়াটদের বিপক্ষে প্রথম গোলটি করেছিলেন মেসি। অসাধারণ পেনাল্টি কিক। ‘দুর্দান্ত পেনাল্টি সেভার’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া লিভাকোভিককে বোকা বানিয়ে পেনাল্টি থেকে গোল করা যেন এই বিশ্বকাপে অন্যতম একটি কৃতিত্বের কাজ। মেসি সেই অসাধারণ কাজটি করে বাহবা কুড়ালেন। তার পাওয়ার শটের সামনে লিভাকোভিকের প্রচেষ্টা নস্যি হয়ে গেলো।

যদিও পেনাল্টি দেয়াটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু মেসি যেন ম্যারাডোনার দেখানে পথটাকেই অনুসরণ করলেন। যেভাবে গোলের সুযোগ তৈরি করলেন, ক্রোয়েশিয়ার দুর্বোধ্য রক্ষণদুর্গ ভেঙে যেভাবে বল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন তাদের বক্সের ভেতর এবং এরপর গোলের আগে ৪৫ ডিগ্রি কোন থেকে ব্যাকপাস হিসেবে ফাইনাল টাচ দিলেন- তা অসাধারণ। ম্যাসির এই রূপের মধ্যে ম্যারাডোনাকেই সবাই দেখতে পেলেন।

ব্যাকপাসটা দিয়ে মেসি বুঝে গিয়েছিলেন ফলাফল কি হচ্ছে। দৌড় থামাননি তিনি। গোলপোস্টের পিছনে আর্জেন্টিনার সমর্থক ভর্তি গ্যালারির দিকে ছুটে গিয়ে থামলেন। উত্তাল গ্যালারি চাচ্ছিলো তাকে আলিঙ্গন করতে। মেসিও হয়তো তাই চাচ্ছিলেন। তবু থামলেন। আর একটা ম্যাচের শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে। সেই ম্যাচ, যা তাকে দিতে পারে অধরা বিশ্বকাপ।

আর তার আগে ৩৯ মিনিটে করা হুলিয়ান আলভারেজের গোলকে কোথায় স্থান দেয়া যায়? মেসি এরই মধ্যে ঘোষণা দিযেছেন, ফাইনালই হবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার শেষ ম্যাচ। আর্জেন্টিনাকে যে জায়গায় রেখে যাচ্ছিলেন মেসি, তখন অনেকেরই চিন্তা ছিল, মেসির পর এই আর্জেন্টিনার হাল ধরবেন কে?

Advertisement

কিন্তু ২২ বছর বয়সী হুলিয়ান আলভারেজের হাতে নীরবে ব্যাটন হস্তান্তর করে দিচ্ছেন মেসি। এরই মধ্যে বলতে গেলে মেসির জুতোয় পা গলিয়ে দিয়েছেন আলভারেজ। ৩৯ মিনিটে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি মাঝমাঠ থেকে একা বল নিয়ে এগিয়ে আসেন ক্রোয়েশিয়া ডিফেন্সে। বক্সে ঢোকার আগে দুইজনকে কাটান। বক্সে গিয়ে বল নিয়ন্ত্রনে নিয়ে গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচকে বোকা বানিয়ে ক্রোয়েশিয়ার জালে বল জড়ান তিনি। একক প্রচেষ্টায় গোলটি করেন আলভারেজ। সেই গোলের পর আলভারেজের কাঁধে উঠে উল্লাসে মাতেন মেসি।

৩-০ গোলে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গেছে আর্জেন্টিনার। লা আলবিসেলেস্তেদের জয়ে তখন গ্যালারি উত্তাল। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে হাত বেঁধে মেসিরা উল্লাসে নাচলেন, গান-গাইলেন। তাদের সঙ্গে কোরাস ধরলেন সমর্থকরা। শিশুর মত নাচলেন মেসিও।

ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলন, সেখানে কথা বললেন লিওনেল স্কালোনি। মেসিদের ট্যাকটিসিয়ান। সেখানে দৃঢ় কণ্ঠে স্কালোনি বললেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। অন্তত আমার কাছে কোনো সন্দেহ নেই যে, লিও’ই (মেসি) হচ্ছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার।’

ফুটবল দুনিয়ায় মেসির শ্রেষ্ঠত্ব আরো একযুগ আগে থেকে। বার্সার হয়ে যখন দিগ্বিজয় করছিলেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যদিও সাফল্য অধরা। কিন্তু বার্সার হয়ে দিগ্বিজয় করে যাচ্ছেন। জিতছেন একের পর এক ব্যালন ডি’অর। ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। করছেন একের পর গোল। যেন এক অপ্রতিরোধ্য গোলমেশিন। সাফল্যের ফ্যাক্টরি।

তখনই আলাপটা উঠেছিলো, সর্বকালের দুই সেরা ফুটবলার পেলে এবং ম্যারাডোনার বিতর্ক কী তবে থামিয়ে দিতে চলেছেন মেসি! কিন্তু মানদণ্ড হিসেবে যে বিশ্বকাপটাকে ধরা হচ্ছে! পেলে জিতলেন ৩টি বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনা একটিতে জিতলেন, আরেকটিতে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন।

গ্রেটনেস নির্ধারিত হবে তো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সাফল্যের নিরিখে। সেখানে মেসি তো একেবারেই কপর্দকশূন্য। কোনো সাফল্যই নেই। সেই মেসি প্রমাণ দিতে শুরু করেছিলেন। ২০১৪ সালে দলকে ফাইনালে তুললেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। একেবারে শিরোপার ধারনপ্রান্ত থেকে ফিরে এলেন।

এরপর টানা দুইবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠলেন। ফাইনালে গিয়ে দু’বারই টাইব্রেকারে হারলেন চিলির কাছে। সাফল্যের খাতা শূন্য। সেই শূন্যতা অবশেষে কেটেছে ২০২১ সালে এসে, মেসির ক্যারিয়ারের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে।

কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে প্রথম শিরোপা জিতলেন মেসি। ১৯৯৩ সালের পর আর্জেন্টিনাকে উপহার দিলেন প্রথম কোনো শিরোপা।

আগেই ওঠা সেই বিতর্কটা আবারও সামনে চলে এলো। পেলে-ম্যারাডোনার গ্রেটনেস পেছনে ফেলতে পারবেন মেসি! কিন্তু এবারও সবার একটাই বক্তব্য, বিশ্বকাপটা হাতে তুলে নিক! সে লক্ষ্যেই প্রাণপন চেষ্টা এবং অপরাজেয় অভিযাত্রা শুরু হলো মেসিদের। ২০১৯ কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে যে সর্বশেষ হেরেছিলেন, তারপর আর কোনো পরাজয় নেই।

টানা ৩৬টি ম্যাচ অপরাজিত থেকে দলবল নিয়ে মেসি প্রবেশ করলেন কাতার বিশ্বকাপে। গ্রুপ পর্বেই টানা অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা পার হয়ে যাবেন তারা, গড়বেন নতুন রেকর্ড- এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা।

কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। সৌদি আরবের সামনে এসে ৩৬ ম্যাচের গৌরবের পায়ে যেন কুঠারাঘাত খেতে হলো আর্জেন্টিনাকে। ২-১ গোলে হেরে মেসিদের অভাবনীয় অবস্থা। মেসি নিজেও বলেছিলেন, ‘আমরা শেষ গেছি।’

সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র নিলেন মেসি। পরের ম্যাচগুলোকে ভাবলেন একেকটি ফাইনাল। একে একে সব বাধা টপকে এখন মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের ফাইনালে। আবারও স্বপ্নজয়ের দুয়ারে এনে দলকে দাঁড় করিয়েছেন মেসি নিজে। একাই করেছেন ৫টি গোল। তিনটি অ্যাসিস্ট। যেন স্বপ্নে মত এক পারফরম্যান্স।

বিমান যেমন আকাশে ওড়ার আগে রানওয়ের শেষে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়ায়। এরপর ডানা মেলে উড়ে আকাশে। মেসির আর্জেন্টিনাও ৩৬ ম্যাচের রানওয়ে ধরে ছুটে আসার পর যেন একটু থমকে দাঁড়ালো। এরপরই মেক্সিকোকে দিয়ে বিমানের মতো ডানায় ভর করে শুধুই উপরে উঠে চলেছে আর্জেন্টিনা। সেই ডানার নাম মেসি।

ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া ডিফেন্স এবং মাঝমাঠে যে শক্তির প্রদর্শণ করেছিলো, তাতে সবাই চিন্তিত ছিল সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার সামনে তেমনটা করলে বিপদ আছে। সেমিতে শুরুতে ক্রোয়েশিয়া সেই লক্ষ্যেই যেন এগিয়ে চলছিলো। কিন্তু মেসি অ্যান্ড কোং যখন খেলাটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন, তখন আর কোনো চিন্তা করতে হয়নি সমর্থকদের। পুরো মাঠে ফুল ফোটালেন তিনি একা। গোল করলেন, করালেন। আর্জেন্টিনাকে অসাধারণ নৈপুণ্যে নিয়ে গেলেন ফাইনালে।

ফুটবল পন্ডিতরা এখনই বলতে শুরু করেছেন, মেসি ফাইনালে গিয়ে কোনো কারণে শিরোপাটা যদি জিততে না’ই পারেন, তবুও লিওনেল স্কালোনির মত বলতে হবে, মেসিই সর্বকালের সেরা। এখানে আর কোনো বিতর্ক নেই।

আইএইচএস/