২০২০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই বছরের ২৫ মার্চ প্রথম দফায় তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপর আর এ উদ্যোগ এগোয়নি।
Advertisement
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাদের সন্তানরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো হয়নি।
এর আগে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে গত বছরের ২৫ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রথম তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযু্দ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথম দফার তালিকায় স্থান পায় ১৯১ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম। যদিও চলতি বছরের (২০২২ সাল) ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পূর্ণাঙ্গ করার কথা জানিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। কিন্তু প্রাথমিক তালিকা প্রকাশের এক বছর ৯ মাস হয়ে এলেও এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা মোটামুটি আমরা করে দিয়েছি, বাকি আছে কিছু। সেটাও করে দেবো।
Advertisement
এই তালিকা প্রণয়নে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব তপন কান্তি ঘোষকে করা হয় কমিটির সভাপতি। মন্ত্রণালয়ের তখনকার অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল হক ভূঁঞাকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়। আর উপসচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত কমিটিতে সদস্য-সচিব হন। কিন্তু গত বছরের ৩০ মে তপন কান্তি ঘোষকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়।
কমিটিতে গবেষক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষক গাজী সালাউদ্দিন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং গবেষক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীরপ্রতীক)।
Advertisement
এদিকে বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) সকালে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, আজকে বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছি। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য। তবে আমাদের আক্ষেপের জায়গা একটি, সেটা হলো বাংলাদেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা এখনো হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও একটা তালিকা করতে পারলাম না। আমরা মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর কাছে বার বার দাবি জানিয়েছি কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর বলেন, শহীদদের যে জায়গায় পৌঁছে দেওয়া দরকার তা পারিনি। তবে আমাদের কাছে প্রতিদিনই ১৪ ডিসেম্বর। রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা দ্রুত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা করবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পূর্ণাঙ্গ করা যায়নি বলে এখনও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা যায় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে পিতার নাম ও ঠিকানাসহ মতামত দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। কমিটিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের মধ্যে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেও বলা হয়। বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকা কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। একই সঙ্গে কমিটিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, জেলা-উপজেলা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত ব্যক্তিদের আবেদন যাচাই-বাছাই ও শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করতে বলা হয়।
এদিকে কমিটি নির্ধারিত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে সব সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক সঙ্গীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
পরে ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর কমিটির প্রথম সভায় প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ১৯৭২ সালে এক হাজার ৭০ জন শহীদের তালিকা, পরবর্তী সময়ে ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদের ডাকটিকিট প্রকাশ করে সেই তালিকাও অনুমোদন দেওয়া হয় ওই সভায়। সবশেষ প্রথম দফার তালিকায় ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম আসে।
আরএমএম/জেডএইচ/জেআইএম