আন্তর্জাতিক

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১০ উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিলো জাতিসংঘ

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১০ প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে উদ্ভাবনী ফ্ল্যাগশিপ স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির দাবি এই ১০টি স্বীকৃতি ধ্বংস হওয়া জলবায়ু বা পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করবে। মধ্য আমেরিকা থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সংগঠন বা সরকারকে ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে। ফলে স্বীকৃতপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা সরকার জাতিসংঘের সমর্থিত প্রচার, পরামর্শ ও তহবিল পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

Advertisement

মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) কানাডার মন্ট্রিয়লের অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে (কপ-১৫) প্রাকৃতিক বিশ্ব পুনরুদ্ধারে তাদের ভূমিকার জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ফ্ল্যাগশিপ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অভিনেতা জেসন মোমোয়া, এডওয়ার্ড নর্টন, ডক্টর জেন গুডাল, পর্বতারোহী নির্মল পুরজা, গায়ক এলি গোল্ডিং, ইউকে ব্যান্ড ব্যাস্টিল ও চীনা সেলিব্রিটি লিলি ভার্চুয়ালি অংশ নেন।

এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলে- ইউএনইপির নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন, এফএওর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মারিয়া হেলেনা সেমেডো ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ স্যার পার্থ দাশগুপ্ত । অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলেন ভারতীয় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার এবং বন্যপ্রাণী চলচ্চিত্র নির্মাতা মালাইকা ওয়াজ।

Advertisement

এর আগে জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় জীববৈচিত্র ও পরিবেশ রক্ষায় ১০টি প্রতিষ্ঠান না ব্যক্তিকে ফ্ল্যাগশিপ পুরস্কার বা স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার জাতিসংঘের সমর্থিত প্রচার, পরামর্শ ও তহবিল পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। ফ্ল্যাগশিপ প্রাপ্তরা এক দশক ধরে কাজ করার পরই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে ইউএনইপির নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে পরিবর্তন করা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এই ১০টি পুরস্কার বিশ্বে জলবায়ু ও পরিবেশ পুনরুদ্ধার ফ্ল্যাগশিপগুলো দেখায় যে রাজনৈতিক ইচ্ছা, বিজ্ঞান ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা জাতিসংঘের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারবো।

এফএও’র মহাপরিচালক কু ডংগু বলেন, এফএও ও এইএনইপি সঙ্গে একত্রে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ওপর নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউএন। ১০টি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দূরদর্শী ও প্রতিশ্রুতিশীল ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার উদ্যোগকে ২০২২ ওয়ার্ল্ড রিস্টোরেশন ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে পুরস্কৃত করতে পেরে আনন্দিত। এই ফ্ল্যাগশিপগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা আমাদের বাস্তুতন্ত্রগুলোকে আরও পুনরুদ্ধার করতে শিখতে পারি।

পুরস্কারপ্রাপ্ত উদ্ভাবনী ফ্ল্যাগশিপগুললো হলো:

Advertisement

ত্রিপক্ষীয় আটলান্টিক বন চুক্তি: আটলান্টিক বন এক সময় ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনার একটি অংশ জুড়ে ছিল। কিন্তু শতবর্ষের কৃষি সম্প্রসারণ ও নগর নির্মাণের ফলে তা খণ্ডিত হয়ে যায়।

তিন দেশেই বন রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের কয়েক দশক ধরে চলা প্রচেষ্টায় শত শত সংস্থা সক্রিয় রয়েছে। তাদের উদ্যোগগুলো জাগুয়ার ও গোল্ডেন লায়ন ট্যামারিনের মতো বিপন্ন প্রজাতির জন্য বন্যপ্রাণী করিডোর তৈরি করছে, মানুষ এবং প্রকৃতির জন্য জল সরবরাহ সুরক্ষিত করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করছে। এতে হাজার হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

আবুধাবি মেরিন পুনরুদ্ধার: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডুগং জনসংখ্যাকে সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ হিসেব তারা ফ্ল্যাগশিপ পুরস্কার পেয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামুদ্রিক ঘাস-নিরামিষ ডুগং পছন্দের খাবার। উপসাগরীয় উপকূলে প্রবাল প্রাচীর ও ম্যানগ্রোভ ফিরিয়ে আনায় ডুগং পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেয়েছে।

আবুধাবি আমিরাতের এ প্রকল্পটি চার প্রজাতির কচ্ছপ এবং তিন ধরনের ডলফিনসহ অন্যান্য অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণির অবস্থার উন্নতি করবে। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো পাঁচশ প্রজাতির মাছের পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি ইকো-ট্যুরিজমের জন্য আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সাড়ে সাত হাজার হেক্টর এরই মধ্যেই পুনরুদ্ধার করা হয়েছে ও ২০৩০ সালের জন্য আরও সাড়ে চার হাজার হেক্টর পুনরুদ্ধার করা হবে।

গ্রেট গ্রিন ওয়াল: গ্রেট গ্রিন ওয়াল হলো আফ্রিকা জুড়ে সাভানা, তৃণভূমি এবং কৃষিজমি পুনরুদ্ধার করার একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ। যা পরিবার ও জীববৈচিত্র্যকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে এবং এরই মধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোকে আরও হুমকির হাত থেকে করছে। আর মরুভূমিকে রক্ষা করতে সহায়তা করছে৷

২০০৭ সালে আফ্রিকান ইউনিয়ন দ্বারা চালু করা এ ফ্ল্যাগশিপটি ১১টি দেশে সবুজ এবং উত্পাদনশীল ল্যান্ডস্কেপের একটি বেল্ট তৈরি করে সাহেল অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করতে চায়।

গঙ্গা নদীর পুনর্জীবন: ভারতের পবিত্র নদী হিসেবে পরিচিত গঙ্গা নদী। এটি প্রবাহ, দূষণ, বনের আচ্ছাদন হুমকির মুখে। ফলে এ বিস্তীর্ণ অববাহিকার আশপাশে বসবাসকারী ৫২০ মিলিয়ন মানুষের জীবন জীবিকা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।

জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং সেচের কারণে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গঙ্গার দুই হাজার ৫২৫ কিলোমিটার পথের অবস্থা আগের তুলনায় নাজুক। তবে ২০১৪ এটি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছে ভারতের সরকার। গঙ্গা ও এর উপনদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে, নদীকে রক্ষা করছে এবং সংরক্ষণ করছে। গঙ্গা অববাহিকার অংশগুলো পুনরুদ্ধার করছে এবং টেকসই চাষের উপযোগী করছে। নদীর ডলফিন, সফটশেল কচ্ছপ, ওটার এবং ইলিশ মাছসহ নদীর পারে বিভিন্ন প্রজাতিকে পুনরুদ্ধার করাও এর লক্ষ্য।

এখাতে ভারত সরকারের বিনিয়োগ এখন পর্যন্ত চার দশমিক২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্রকল্পে দুইশ ৩০টি সংস্থার অংশগ্রহণ রয়েছে, যার মধ্যে দেড় হাজার কিলোমিটার নদী পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। উপরন্তু, এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার হেক্টর বনায়ন হয়েছে।

মাল্টি-কান্ট্রি মাউন্টেন ইনিশিয়েটিভ: পার্বত্য অঞ্চলগুলো ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, মাটি ক্ষয় হচ্ছে এবং প্রজাতিগুলি প্রায়ই বিলুপ্তির দিকে। সার্বিয়া, কিরগিজস্তান, উগান্ডা ও রুয়ান্ডায় এটি রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ায় তাদের ফ্ল্যাগশিপ পুরস্কার দেওয়া হয়।

ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার ড্রাইভ: তিনটি ছোট দ্বীপের উন্নয়নশীল রাজ্য- ভানুয়াতু, সেন্ট লুসিয়া কমোরোসের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। দ্বীপের সম্প্রদায়গুলোকে কোভিড-১৯ মহামারি থেকে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করা হয়। এজন্য সাগর কেন্দ্রিক নীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে।

উদ্যোগগুলো মধ্যে রয়েছে- প্রবাল প্রাচীরের ওপর চাপ কমানো, ঝড়ের সময় যথাসম্ভব ঝুঁকিমুক্ত রাখা এবং সাগরে মাছের মজুত আগের মতো ফিরিয়ে আনা।

আলটিন ডালা সংরক্ষণ উদ্যোগ: বিশ্বের অনেক তৃণভূমির মতো মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ ও আবাদযোগ্য জমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। এমনকি এর থেকে রক্ষা পাচ্ছে না চরগুলোও। এর ফলে জলবায়ুর ওপর প্রভাব পড়ছে।

২০০৫ সাল থেতে কাজাখস্তানের আলটিন ডালা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে মরুভূমি ও চর রক্ষা পাচ্ছে। এক সময় প্রচুর পরিমাণে হরিণ শিকার বাস্তুচ্যুত হতো। এই উদ্যোগের ফলে হরিণ তাদের বাসস্থান ফিরে পাচ্ছে।

সেন্ট্রাল আমেরিকান ড্রাই করিডোর: তাপপ্রবাহ এবং অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাতের সংস্পর্শে, সেন্ট্রাল আমেরিকান ড্রাই করিডোরের বাস্তুতন্ত্র এবং জনগণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৯ সালের হিসাবে খাবারের কারণে গত পাঁচ বছরে এ অঞ্চলের এক দশমিক দুই মিলিয়ন লোককে খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন।

কোস্টারিকা, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া এবং পানামা বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় এ পুরস্কার দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ- কফি, কোকো ও এলাচের মতো ফসল দিয়ে কীভাবে বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে তারা।

ইন্দোনেশিয়ায় প্রকৃতির সঙ্গে বিল্ডিং: ইন্দোনেশিয়ার প্রধান দ্বীপ জাভাতে প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেখানার নিচু উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন করায় ভূমি হ্রাস পেয়েছে এবং বাসস্থান বেড়ে যাওয়ায় ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হয়েছে।

এখন সেখানে প্রাকৃতিকভাবে ম্যানগ্রোভের পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। জীব বৈচিত্র্য করা করতে কৃষকদের টেকসই কৌশল শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তাদের চিংড়ির উৎপাদন বাড়িয়েছে। ক্যাচের উন্নতিও দেখেছে।

চীনে শান-শুই উদ্যোগ: এ উদ্যোগটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশজুড়ে পাহাড় থেকে উপকূলীয় মোহনা পর্যন্ত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য ৭৫টি বড় প্রকল্প নেওয়ার হয়েছে। এটি ২০১৬ সালে চালু করা হয়।

উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝেজিয়াং প্রদেশের ওজিয়াং রিভার হেডওয়াটার প্রকল্প। যা জমির ব্যবহারকে আরও টেকসই করার জন্য ঐতিহ্যগত কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে একীভূত করে, যেমন ঢালের ছাদ তৈরি করা এবং মাছ-হাঁস পালনের সঙ্গে ফসলের সংমিশ্রণ।

এইচএস/আরএডি