আহমাদ আলী
Advertisement
১৯৭১ সাল দেশে যুদ্ধ চলছে। তখন আমার বয়স ৬-৭ বছর। তাতে কী, এ সময়ের ঘটনা আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে। আমরা তখন সপরিবারে (মা-বাবা, মেজভাই-ভাবি, আমি ও আমার অগ্রজ ভাই) পুরান ঢাকার লালবাগের কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডে নিজবাড়িতে ছিলাম। তখন এখানে এতটা ঘনবসতি ছিল না। আমাদের বাড়িটি লালবাগ কেল্লার ঠিক দক্ষিণে, মন্দিরের কাছে। এ মন্দিরে কখনো শাঁখের ধ্বনি শোনা যায়নি, এমনকি পূজা-অর্চনাও হতে দেখিনি কখনো। সম্ভবত এটি আগেই বেদখল বা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। মন্দিরটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রভাবশালীরা এটিকে হিন্দু বাবুদের কাছ থেকে কিনে ইট-বালির গাঁথুনিতে ঢেকে দিয়েছেন। লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রেখেছেন, তবে ভাঙা হয়নি। এ এলাকায় এখনো একাধিক মন্দির বা মঠ রয়েছে, যা পরিত্যক্ত অবস্থায় লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে। বলতে গেলে বুড়িগঙ্গার কাছে হলেও আশপাশে ছিল কয়েকটি পুকুর বা ডোবা। তবে তেমন ঘনবসতি না থাকায় প্রধান সড়কের লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া এবং লালবাগ কেল্লায় আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সহজেই নজর কাড়তো। বাড়ির পাশে ছিল এটলাস নামে একটি অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। এখানে হেলিকপ্টার ব্র্যান্ডের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল বা তৈজসপত্র তৈরি হতো। কারখানাটি ছিল পাকিস্তানি এক খানের।
দেশে যুদ্ধ চলছে, মুক্তিযুদ্ধ। গ্রামের লোকেরা এখনো এ মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকে গণ্ডগোলের বছর হিসেবে উল্লেখ করেন। তাদের এ সহজ-সরল উক্তির অর্থ হলো দাঙ্গা-হাঙ্গামার বছর। গণ্ডগোলের বছর বলারও একটি যুক্তি বা ব্যাখ্যা আছে। এর মূল কারণ ৯ মাসে একটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করতে পারে—এমন নজির বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। এ ছাড়া যে বছর যুদ্ধ শুরু, সে বছরই দেশ স্বাধীন হয়। তাই হয়তো গ্রামের লোকেরা সহজ ভাষায় এ সময়কে ‘গণ্ডগোলের বছর’ হিসেবে আখ্যা দেন। মা বলতেন, যুদ্ধের বছর আমরা পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি (মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রাম) গিয়েছিলাম। তারপরও গ্রামের পথে হেঁটে যাওয়ার কিছুটা স্মৃতি এখনো আমার হৃদয়পটে গেঁথে আছে। দিন-তারিখ মনে নেই। যুদ্ধের বছর দিনভর আকাশে যুদ্ধবিমানের দাপাদাপি দেখে কখনো উৎফুল্ল হয়ে হাততালি দিতাম, আবার কখনো বিমানকে লক্ষ্য করে কামানের গোলা বা মিসাইল ছোড়ার শব্দে কানে আঙুল দিতাম। গোলাগুলির শব্দ আমরা একটু বেশিই পেতাম। এর কারণ পিলখানা ছিল (বর্তমান বিজিবি হেডকোয়ার্টার) আমাদের খুব কাছে। বিমানের আনাগোনা আর গোলার ধোঁয়ায় দিনের আকাশকে মনে হতো নক্ষত্রের হাট। দিন পেরিয়ে রাত আসে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, গোলাগুলির শব্দ যেন ততই বাড়ছিল। আমাদের বাড়ির ছাউনিটি ছিল টিনের। রাতভর প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বন্দুক আর রাইফেলের গুলির খোসা এসে আমাদের টিনের চালে পড়ছিল মুষলধারায় বৃষ্টির মতো। রাত গভীর, ভোর ছুঁই ছুঁই করছে, অবিরাম গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা আমাদের রাতেই একটু দূরত্বে নদী পার হয়ে (বর্তমান লালবাগের ইসলামবাগ) এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে রাখলেন। অপেক্ষা ফজরের আজানের। তখন নাকি কিছু সময়ের জন্য গোলাগুলি বন্ধ থাকে। রাত ভোর হলো, মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ফজরের আজান—‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ মানে ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান’। সেদিন রাতে আর ঘুম হয়নি। আজানের সাথে সাথে বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন ঢাকার কালীগঞ্জে (সদরঘাটের বিপরীত পাড়ে) তার এক দূরসম্পর্কের ভাইয়ের বাসায়। যেদিন সেখানে গেলাম, সেদিন রাতেই সূত্রাপুরের গেন্ডারিয়ায় আগুন দিয়েছিল পাকহানাদার বাহিনী। মনে হলো দৃশ্যটি খুব কাছ থেকে দেখলাম।
পরের দিন কালীগঞ্জ ছেড়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম নিজগ্রাম বিক্রমপুরের উদ্দেশে। সেদিন সকাল থেকে শুধুই হেঁটেছি শেষ গন্তব্য পর্যন্ত। মনে আছে চলতিপথে উৎসুক জনতা পথচারীদের কাছ থেকে ঢাকার অবস্থা জেনে নিচ্ছেন।
Advertisement
সেদিন শুধুই হেঁটেছিলাম। গ্রামের নির্জন পথ লোকে-লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। সারা রাস্তায় মানুষের মেলা বসেছিল। দেখেছিলাম, হিন্দু-মুসলিমের ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে জড়ো হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভূপেন হাজারিকার সে বিখ্যাত গানের আহ্বানে—‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য...’। দেখেছিলাম, মায়ের কোলে ক্ষুধার্ত শিশুটির জন্য সেদিন কেউ কেউ দুধভর্তি পাত্র হাতে, আবার কেউ পানি বা শরবতের পাত্র নিয়ে সারি সারি ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন। যার যেটা প্রয়োজন, তা নিয়ে পান করেছেন বা করিয়েছেন। এ দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু স্মৃতিকে ফাঁকি দেওয়া মোটেও সম্ভব নয়। যে কোনো ঘটনা-অঘটন স্মৃতিকে একদিন না একদিন জাগিয়ে তুলবেই। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানুষের মধ্যে সহযোগিতার যে ধারা বয়ে যেতে দেখেছি, তার এক ছিটেফোঁটাও যদি এখন আমাদের মাঝে থাকতো, তাহলে এ সবুজঘেরা, শস্য-শ্যামলা দেশটা কতই না সুন্দর হতো। এ দেশের মানুষ সোনার ফসল ঘরে তুলে কতই না সুখ-শান্তিতে কাটাতে পারতো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূলত এখানেই। ওই চেতনা বিদ্যমান থাকলে আমরা একে পুরো ভাগে জাগরুক রাখতে পারতাম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকাল ধরে। একসময় আমাদের গ্রামবাংলারই ঐতিহ্য ছিল গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু। এখন ধান তো দূরে থাক, কৃষকের শূন্য গোলা পাওয়াও ভার। ‘মাছেভাতে বাঙালি’ এ তো দিব্যি প্রবাদ বাক্যে রূপ নিয়েছে।
ঢাকা কালীগঞ্জ থেকে ভোর-বিহানে রওনা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সৈয়দপুরের মরিচায় এসে পৌঁছলাম। অনেক কষ্টে একটি নৌকা পাওয়া গেল। ভাড়া ঠিকঠাক হওয়ার পর নৌকায় উঠলাম। নৌকা চলছে নদীর পাড়ঘেঁষে, আবার কখনো খালের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রাজানগর, শেখের নগর, আলমপুর, আড়িয়ল বিল, ষোলঘর, শ্রীনগর, গোয়ালী মান্দ্রা অনেক মাঠঘাট পেরিয়ে অবশেষে রাতের বেলা গন্তব্যে পৌঁছলাম। নৌকায় ওঠার পর ক্লান্ত শরীর আধো ঘুমের কাছে সঁপে দিয়েদিলাম। নৌকা যখন গন্তব্যস্থল কুমারভোগ পৌঁছল খুব সম্ভব বাবা আমার ঘুম ভাঙালেন। নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। পাড়ার লোকজন ভিড় জমিয়েছে আমাদের দেখার জন্য এবং কুশল জানার জন্য। শরীর তখন ক্ষুধায় কাতর। আমাদের পাড়াতেই বড়বোনের বিয়ে হয়। তাই তিনি সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। আমরা সেদিন তার বাড়িতেই শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। রান্না করা খাবার যেটুকু ছিল, ছোট দুই ভাই তা দিয়ে পেটকে সুবোধ দিলাম। আমাদের দেখার সাথে সাথে চুলায় ভাতও বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই গ্রামের রেওয়াজ।
বাবা গ্রামের বাড়িতে আমাদের রেখে পরদিন ঢাকায় চলে গেলেন। মেজভাই ছিলেন ঢাকায়। গ্রামের বাড়িতে যুদ্ধের প্রভাব তেমন একটা বুঝতে পারলাম না। তবে রেডিও অন করলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত খবরে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যেতো। মনে আছে, এম আর আখতার মুকুলের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘কি পোলারে বাঘে খাইলো...’। যুদ্ধে পর্যুদস্ত পাকহানাদারদের নানা কর্মকাণ্ড এভাবে রম্যরসিকতার মাধ্যমে তুলে ধরে এম আর আখতার মুকুল মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-প্রেরণা জোগাতেন এবং দেশের মানুষকে প্রবোধ দিতেন। সন্ধ্যার পর রেডিওতে বিবিসির খবর শোনার জন্য রীতিমতো ছেলে-বুড়োদের ভিড় জমতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসির খবর বেশ প্রাধান্য দেওয়া হতো। এ খবরের মাধ্যমে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতো। তাই রেডিওতে বিবিসির খবর শোনার জন্য কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যার সাথে সাথে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গ্রামের লোকজন খোঁজ রাখতেন, কে ঢাকায় গেল আর কে ঢাকা থেকে এলো। তাদের কাছ থেকে পরিচিতজন বা স্বজনের খোঁজখবর জানার চেষ্টা করতো। যুদ্ধকালীন গ্রামের বাড়িতে কতদিন ছিলাম তা মনে নেই। যদ্দুর মনে পড়ে, মাঝে কুমারভোগ বড়বোনের বাড়ি থেকে কোলাপাড়া মেজবোনের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানেও কাটিয়েছি বেশকিছু দিন। খবর পেলাম ঢাকায় পাকহানাদারদের অত্যাচার বড্ড বেড়ে গেছে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে কিশোর-যুবকদের অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা এবং মেজভাই গ্রামে ফিরে এলেন। তারা ইসলামবাগের চাঁদনীঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদী সাঁতরে জিঞ্জিরা পার হয়ে গ্রামে এসেছিলেন। সেদিন তাদের পিছু নিয়েছিল পাকহানাদার বাহিনী। তাদের হাঁকডাকে সাড়া না দিয়ে তারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেই গুলি চালিয়েছিল কয়েক রাউন্ড। পাকহানাদারদের ছোড়া একটি গুলি সেদিন মেজভাইয়ের মাথা ছুঁই ছুঁই চলে যায়। ডুব সাঁতারের কারণে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা প্রাণে রক্ষা পান। আল্লাহ সহায়, নয়তো মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারাদের কাতারে যোগ হতো আমাদের পরিবারও। এসব কথা মায়ের কাছ থেকে শোনা। যেদিন তারা শহর ছাড়েন; সেদিন রাতেই পাকহানাদাররা ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আগুন দেয়।
যুদ্ধের তীব্রতা যত বাড়ছে, দেশ স্বাধীনের ক্ষণ যেন ততই ঘনিয়ে আসছে। পাকহানাদারদের অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন, গুম-হত্যার মাত্রাও যেন ক্রমে বাড়ছে। এতে দেশের মানুষ কিছুটা বিচলিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর মনোবল ভাঙতে পারেনি। যুদ্ধকালীন একটি স্লোগান মনে পড়ছে। খুব সম্ভব স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো—‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। দেশকে হানাদার-আলবদর মুক্ত করার যুদ্ধ চলছে ৯ মাস।
Advertisement
দেশব্যাপী যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বুদ্ধিজীবী নিধন ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে হায়েনার দল। মা-বোনদের ইজ্জত-সম্ভ্রমসহ সবকিছু লুটে নিচ্ছে শকুনের দল। এদের রোষানল থেকে মাতৃক্রোড়ের শিশুটিও রক্ষা পায়নি। হায়েনার তীব্র থাবায় কত মায়ের বুক যে খালি হয়েছে, এর হিসাব নেই। হায়েনার দলের জুলুম-অত্যাচারে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে দিন দিন। অবশেষে ৩০ লাখ শহীদ আর অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম-আভ্রুর বিনিময়ে এলো স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ। একসময় শোনা গেল, জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বশ্যতা মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। দেশ স্বাধীনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র উঁচিয়ে উল্লাস করছে। তাদের চোখেমুখে একদিকে জ্বলজ্বল করছে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে সহযোদ্ধা আর স্বজন হারানোর বেদনা তাদের তাড়িত করছে। এ আনন্দ-বেদনা নিয়েই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে গন্তব্যে ফিরছেন। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা পেলাম একটি স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’, জাতি পেলো স্বতন্ত্র একটি পরিচয় ‘বাঙালি’। দেশের আনাচে-কানাচে হলুদ রঙে আঁকা মানচিত্র খঁচিত লাল-সবুজ পতাকা পত পত করে উড়ছে। বর্বর পাকহানাদারদের কুপোকাত করে আমরা বিজয় অর্জন করেছি, পেয়েছি ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঠিকানা।
সবচেয়ে বড় কথা, একটি দেশ স্বাধীন করতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম বা সৈন্য-সামন্ত দরকার; তা আমাদের ছিল না। ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক অকুতোভয় ও নির্ভীক সংগ্রামী নেতা, ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুরিত কবিতা ও গান (শিকল পরা ছল মোদের শিকল পরা ছল, এ শিকল পরে শিকল তোদের করবো রে বিকল’), যা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জোগাতো। ছিল এম এ জি ওসমানীর মতো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতো সাহসী বীর। আরও ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগারসদৃশ শক্তিধর একদল যোদ্ধা এবং একঝাঁক বালক বয়সী বিচ্ছুবাহিনী। বলতে গেলে, এ জন্যই মাত্র ৯ মাসে (২৬৬ দিনে) আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চের ঘোষণা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেলো ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতাকামী মানুষ যেন আনন্দে আবেগাপ্লুত এবং বাকরুদ্ধ। নিখোঁজ পুত্র-কন্যা, বাবা-মা, ভাইবোন বা স্বজনদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন অনেকে। দেশের বুদ্ধিজীবী নিধন আর হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ পাওয়া গেলো ঢাকার পিলখানা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে অসংখ্য লাশের মধ্য দিয়ে।
আমরা মুক্ত-স্বাধীন। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র একে একে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। দু’একটি রাষ্ট্র আমাদের এ বিজয় মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা সমর্থন দিতে কার্পণ্য করলো। অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দু’একটি রাষ্ট্র সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো। প্রয়াত সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাহায্যার্থে ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে কনসার্ট করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের পাশাপাশি আমাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। যার ইতিহাস এ প্রজন্মের কারো অজানা নেই।
দেশকে রাজাকার-আলবদর মুক্ত করার শুদ্ধি অভিযান চলছে। ‘একটি-দুটি রাজাকার ধরো, সকাল-বিকাল নাশতা করো’—স্লোগানে চলছে রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর সদস্যদের সন্ধান। যারা যুদ্ধের সময় বাংলার মেধানিধন ও মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনে পাকহানাদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিল। শুনতে পেলাম জগন্নাথ সাহা রোড কেল্লার মোড়ের মিয়া সরদারকে (মিয়া মোহাম্মদ) মুক্তিযোদ্ধারা লবণকেচা করেছে। তার এ দুর্গতি অনেকে স্বচক্ষে দেখলেও কারো মনে বিন্দুমাত্র মায়ার উদ্রেক হয়নি। মিয়া সরদার একটি উদাহরণ মাত্র। দেশ স্বাধীনের পর এভাবেই রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর সদস্যদের শায়েস্তা করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধকালীন দেখেছি, রাজাকার, আল-বদররা সাধারণ মানুষের পোষাপ্রাণি থেকে শুরু করে ধন-সম্পদ লুটপাট করে কীভাবে অগাধ সম্পদের মালিক বনে গেছে।
সময়টা ছিল দেশ স্বাধীনের পর। মেজবোনের অসুস্থ শ্বশুর (গ্রামে থাকতেন) ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাকে দেখার জন্য মায়ের সাথে আমিও হাসপাতালে গেলাম। তখন গাড়ি-ঘোড়ার এতটা আধিক্য ছিল না। তাই পায়ে হেঁটেই লালবাগ থেকে সেখানে যাওয়া হয়েছিল। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যুদ্ধ-উত্তর দেশের অনেক কিছুই চোখে পড়েছে। যা আজ স্মৃতিবদ্ধ হয়ে আছে। রোগী দেখে বাড়ি ফেরার পথে মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছের একটি ডাস্টবিনে তাজা গুলির স্তূপ নজর কাড়লো। শিশুমনে মায়ের অজান্তে পা দিয়ে নাড়া দিতেই ভাঙা কাচে পায়ের আঙুল কেটে গেলো। মা বিষয়টি টের পেলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। পাশেই ছিল একটি পান বিতান, মা সেখান থেকে পানের বোঁটায় একটু চুন নিয়ে কাটা অংশে লাগিয়ে দিলেন। কাটা-ছেঁড়ার জন্য এটা একটি টোটকা চিকিৎসা। আঙুল কাটলেও হাতে করে দু’একটি গুলি নিতে ভুললাম না। পরে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে বাড়ি পৌঁছলাম। পরে এ রকম হাজার হাজার গুলি দেখেছি ভাঙারি ব্যবসায়ীরা এনে কৌশলে বারুদ (দেখতে সরু শলাকার মতো) বের করে খোসা থেকে তামা, পিতল আর সিসা আলাদা করেছে। গুলির মাথার অংশটি (সিসার তৈরি) দেখতে ছিল অনেকটা রকেটের মতো। স্বর্ণকারের মাধ্যমে এটা দিয়ে অনেকে আংটি বানিয়ে পরেছেন। যতদূর মনে পড়ে এ থেকে আমিও বাদ যাইনি।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আজকের দর্পণ।
এসইউ/জেআইএম