বেশ কয়েক মাস ধরেই ইউরোপের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। যদিও ১৯২২ সালের গ্রীষ্মকালে হঠাৎই নাটকীয়ভাবে সব পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। জার্মানিতে ১৯১৪ সালে একটি রুটির দাম ছিল জার্মান মুদ্রায় শূন্য দশমিক ৩০। ১৯২২ সালের শুরুর দিকে জার্মান মুদ্রায় দাম বেড়ে হয় ৮ এবং সে বছরের শেষ নাগাদ দাম বেড়ে হয়েছিল ১৬০। ১৯২২ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে জার্মানির মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছিল ৩২২ শতাংশ।
Advertisement
ওয়াইমার জার্মানিতে যেটি ঘটেছিল তা ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সেই পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে অস্ট্রিয়ান লেখক স্টিফান জুইগ তার বিখ্যাত ১৯৪২ সালের স্মৃতিকথা দ্য ওয়ার্ল্ড অব ইয়েস্টারডে-তে লিখেছেন, ‘জার্মান জনগণকে এতটা তিক্ত, এতটা ঘৃণাপূর্ণ মূল্যস্ফীতি, হিটলারের মতো আর কিছুই করেনি।’ ঠিক একশ বছর পর, ইউরোপের যুদ্ধের কারণে ইউরোপে আবারও মূল্যস্ফীতি গ্রাস করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ভাগ্যবশত, একটি দূরবর্তী দর্শন, কেননা ইউরোপের অর্থনীতি শক্তিশালী ও নীতিনির্ধারকরা ঋণকে টেকসই রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ২০২৩ সালে মূল্যবৃদ্ধির অর্থনৈতিক প্রভাব ও জ্বালানির যে সংকট তৈরি হয়েছে তা ইউরোপজুড়ে সাপেবর হবে, যা প্রথমে মন্দার দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে এগোবে।
জ্বালানির কথাই শুরুতে ধরা যাক। ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া কিয়েভের পশ্চিমা সমর্থকদের বিরুদ্ধে জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে এবং গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক ফরাসি পারমাণবিক-বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামতের জন্য স্থগিত রাখা হয় এবং ইউরোপজুড়ে খরা জলবিদ্যুতের প্রাপ্যতাও হ্রাস করে। ‘চোখে জল আনা’ দামি গ্যাসে চলমান প্ল্যান্টের শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়েছে।
২০২৩ সালে জ্বালানি আরও ব্যয়বহুল হবে। ইউরোপ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানির পরিমাণ ও সক্ষমতা বাড়িয়েছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী সরবরাহ খুব বেশি বাড়বে না। গ্যাস-স্টোরেজ প্রায় পূর্ণ এবং বসন্তের পর শরতেও পুরোপুরি খালি হবে না। কিন্তু তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো পশ্চিমাদের কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তেলের ঘাটতি জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। ফরাসি পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো আবারও উৎপাদন শুরু করবে। তবে বিদ্যুতের খরচ খুব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
Advertisement
ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। এটা ঠিক যে, অপরিশোধিত জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বছরের পর বছর তুলনা করার মানে হলো ২০২৩ জুড়ে মূল্যস্ফীতি প্রায় সংকুচিত হবে।
কিন্তু কিছু জ্বালানির দাম দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ব্যবহার করে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং কতগুলো এখনও সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়নি। অর্থনীতির বাকি অংশে, জ্বালানি-মূল্যের ধাক্কা লাগবে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে মজুরি বাড়বে, ফার্মের খরচও বাড়বে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মার্জিন রক্ষা করার জন্য গ্রাহকদের কাছে দায় চাপাবে। ফলে অর্থনীতিতে প্রতিটি পণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম, যা মূলত জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, ধীর হতে আরও সময় লাগবে।
ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং পিছিয়ে যাওয়া শুরু করবে। ২০২২ সালে, কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের একটি বছর ছিল, যে সময়টাতে রৌদ্রোজ্জ্বল ছুটির দিন ও অভিনব রেস্তোরাঁর চাহিদা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে, পারিবারিক ক্ষেত্রে বাজেট দ্বিগুণ হলে এই শিল্পখাত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। জ্বালানির বাড়তি বিল ও মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সুদের হার উচ্চ থাকায় বন্ধকি অর্থপ্রদান বৃদ্ধি পাবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপে পড়বে এবং বিনিয়োগও কমবে। এই সবই ইউরোপের অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেবে।
পূর্ববর্তী মন্দার বিপরীতে, বিশ্ব অর্থনীতি ইউরোপের উদ্ধার করতে নাও এগিয়ে আসতে পারে। শিল্পের জন্য রপ্তানি আদেশ ২০২৩ সালে কম থাকবে, কারণ উচ্চ সুদের হার, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট ও শক্তিশালী ডলার সারাবিশ্বে চাহিদাকে দুর্বল করে দেয়। শুধু একবার জ্বালানির দাম কমে গেলে এবং আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হলে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কি ইউরোপের পুনরুদ্ধারকে সমর্থন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ২০২৩ সালে তা হবে না।
Advertisement
তবে সবচেয়ে উজ্জ্বল খাত হলো শ্রমবাজার। ইউরোপের অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান শ্রমিকের অভাব হচ্ছে, কারণ বয়স্করা অবসর নিচ্ছে এবং অল্পবয়সী, কম জনবহুল প্রজন্ম কর্মীবাহিনীতে প্রবেশ করছে। সংস্থাগুলো কর্মীদের অপ্রয়োজনীয় মনে করার আগে দুবার চিন্তা করবে এবং উদার সহায়তা স্কিমগুলো চাকরি সংরক্ষণে সহায়তা করবে। অনেক ভোক্তা ২০২৩ সালে তাদের জ্বালানি বিল ও বন্ধকি পেমেন্ট নিয়ে চিন্তিত হলেও খুব কম লোকই তাদের চাকরি হারানোর ভয় পাবেন।
পরিবার ও ব্যবসার জন্য সর্বসাকুল্যে জনসাধারণের সমর্থন ২০২৩ সালে ইউরোপে একটি গভীর মন্দা প্রতিরোধে সহায়তা করবে। মহাদেশজুড়ে সরকারগুলো তাদের ভোটারদের অসাধ্য জ্বালানি বিলের প্রভাব থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এটি তাদের প্রকৃত আয়সীমার নিচে রাখবে এবং জ্বালানি সংকটের অর্থনৈতিক পতনকে সীমিত করবে। অর্থনীতির একটি জনপ্রিয় সূচক মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করে এই সূচক।
ফলে এটি রাজনৈতিক বিভাজন কমাতেও সাহায্য করবে, কেননা ইতিহাস শেখায় যে মূল্যস্ফীতিও রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
এসএনআর/এসএইচএস/জিকেএস