মতামত

রাজনীতির খেলায় কে জিতলো?

বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক পর্ব খেলা হয়ে গেলো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল হবে ১৮ ডিসেম্বর। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির ফাইনাল খেলা হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে। তবে বিশ্বকাপের মতো রাজনীতিতেও বিভিন্ন গ্রুপে, বিভিন্ন ধাপে খেলা হয়।

Advertisement

তেমনই একটি খেলা ছিল ১০ ডিসেম্বর। সেদিন আসলে বিএনপির ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশের চূড়ান্ত সমাবেশ ছিল। নিছক একটি বিভাগীয় গণসমাবেশকে উত্তেজনাপূর্ণ খেলায় পরিণত করার দায় বা কৃতিত্ব পুরোটাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। খেলার ফলাফলও তিনিই ঘোষণা করেছেন। ফলাফলে পরে আসছি।

গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি, যার শেষটি ছিল ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। ঢাকার আগে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ছাড়া বাকি বিভাগীয় সমাবেশের স্থানীয়ভাবে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সমাবেশে লোকসমাগম কম রাখার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সরকারি দলের সে চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। বরং বাধা পেয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা আরও বেশি উদ্দীপনা নিয়ে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন।

সরকারি দল বাধা দিয়ে বিএনপির একদিনের সমাবেশকে তিনদিনের আয়োজন বানিয়ে দিয়েছে। পরিবহন ধর্মঘট এড়াতে বিএনপির নেতাকর্মীরা দু-তিনদিন আগে থেকে সমাবেশস্থলে অবস্থান নেন। তারা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেন। সরকার বাধা না দিলে লোক হয়তো আরেকটু বেশি হতো। কিন্তু সেটি একদিনেই সীমাবদ্ধ থাকতো। বাধা দিয়ে সরকার আসলে বিএনপির উপকারই করেছে।

Advertisement

বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের দারুণ চাঞ্চল্য এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এজন্য তারা সরকারি দলকে ধন্যবাদ দিতেই পারে। নানা কৌশলে লোক সমাগম কমানোর চেষ্টা করলেও মূল সমাবেশে সরকার বা সরকারি দল বাধা দেয়নি। ফলে সবগুলো বিভাগীয় সমাবেশই সফল ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় ছিল এই বিভাগীয় সমাবেশের শেষটি। কিন্তু বিএনপির মাঝারি সারির কয়েকজন নেতার হম্বিতম্বি আর তাতে সরকারি দলের অতি প্রতিক্রিয়ায় ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে দেশজুড়ে উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। এর শুরুটা করেছিলেন আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। একটি বিভাগীয় সমাবেশ থেকে কীভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়ে যাবে, সে ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

বরং ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ থেকে আমানউল্লাহ আমান সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমানউল্লাহ আমানের লাগানো আগুনে পানি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও। মির্জা ফখরুল বারবার সরকারি দলকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছেন, এটি তাদের আরেকটি বিভাগীয় সমাবেশমাত্র, সরকারকে বিব্রত করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।

সরকারি দল চাইলে আমানউল্লাহ আমানের পলিটিক্যাল রেটরিককে উপেক্ষা করতে পারতো। কিন্তু কয়েক লাখ লোক নিয়ে বিএনপি রাস্তায় বসে যেতে পারে, এমন শঙ্কা থেকে সরকার কোমর বেঁধে নামে। বিএনপি যতটা শক্তিশালী, সরকারি দল তাদের তারচেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ধরে নিয়ে হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। বিএনপি যতই বলে, আমরা কিছুই করবো না; সরকারি দল ততই, বিএনপি সন্ত্রাস করবে; বলে তাদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামে।

Advertisement

লড়াইটা শুরু হয় ১০ ডিসেম্বরের ভেন্যু নিয়ে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় ১০ লাখ, ২০ লাখ লোক আসবে, বিএনপির এমন আশাবাদের জবাবে সরকার তাদের টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান বা পূর্বাচলের বাণিজ্য মেলার মাঠে সমাবেশ করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু বিএনপি ঢাকার ভেতরে সমাবেশ করতে চাইলে সরকার তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ব্যাপারে সরকারই বেশ আন্তরিকও ছিল। বিএনপির সমাবেশের সুবিধার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছাত্রলীগের সম্মেলন ৮ ডিসেম্বর থেকে এগিয়ে ৬ ডিসেম্বর করা হয়। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় থাকলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

নয়াপল্টন না সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এ নিয়ে উত্তেজনা চরমে ওঠে। সরকার অনুমতি না দিলে নয়াপল্টনে সমাবেশ করা সম্ভব নয় জেনেও বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। সমাবেশের তিনদিন আগে থেকেই বিএনপির নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করলে ৭ ডিসেম্বরই পুলিশ পিটিয়ে তাদের এলাকাছাড়া করে এবং বিএনপি কার্যালয়ের দখল নিয়ে নেয়।

বুধবারের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু হয়, আহত হন অনেকে। পুলিশ কয়েকশো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সেদিন রাতে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ঢাকার বিভাগীয় সমাবেশের সমন্বয়ক মির্জা আব্বাসকে। তবে আড়ালে সমঝোতা চেষ্টাও ছিল।

বিকল্প ভেন্যু হিসেবে নাম আসে কমলাপুর, মিরপুর বাঙলা কলেজ। শেষ পর্যন্ত সমাবেশের আগের দিন ভেন্যু চূড়ান্ত হয় গোলাপবাগ মাঠ। ভেন্যু নিয়ে এই টানাপোড়েন আসলে দুই পক্ষেরই কৌশলের অংশ। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে শেষ দিন পর্যন্ত অপ্রস্তুত রাখতে চেয়েছে, যাতে তারা সমাবেশে মনোযোগী হতে না পারে, যাতে লোক সমাগম কম হয়। আর নয়াপল্টনে সমাবেশ করা যাবে না জেনেও অনড় থেকে বিএনপি সবাইকে দেখাতে চেয়েছে, সরকার অগণতান্ত্রিক।

সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকারও তারা কেড়ে নেয়। রাজনৈতিক দলের অফিসও পুলিশ দিয়ে দখল করে নেয়। ঢাকায় আনুষ্ঠানিক ধর্মঘট না ডাকলেও প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসায় পুলিশ। এমনকি মানুষের মোবাইলের মেসেজও চেক করেছে তারা। আমার ধারণা দুই পক্ষের এই কৌশলের খেলায় বিএনপির জয় হয়েছে। সরকার স্বাভাবিকভাবে বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দিলে সেটা হতো একদিনের ইভেন্ট। কিন্তু বাধা দিয়ে সরকারি দল সেটাকে সপ্তাহব্যাপী আয়োজন বানিয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে ছিল ১০ ডিসেম্বর। দেশের মানুষকে তো বটেই আন্তর্জাতিক মহলকেও উদ্বিগ্ন করেছে ১০ ডিসেম্বর।

নানা বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশ ভালোই হয়েছে। তবে সমাবেশ থেকে যে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছে তাতে নতুন কিছু নেই। দাবি আদায়ে ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দেখেও মনে হয়েছে আন্দোলনের মোমেন্টাম ধরে রাখার কোনো চেষ্টা আপাতত তাদের নেই। তবে এখনই আমি বিএনপির গণমিছিলের তারিখ বদলানোর পরামর্শ দিয়ে রাখলাম। ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হবে। সে তারিখ অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিন বিএনপির গণমিছিল রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে।

গণসমাবেশ থেকে বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। পরদিন তারা স্পিকারের কাছে গিয়ে পদত্যাগপত্র দিয়েও এসেছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির এমপিরা পদত্যাগ করলে সংসদ অচল হবে না। আমি তার কথার সাথে একমত। বিএনপির সাত এমপির থাকা না থাকায় আসলে কিছু যায় আসে না। বিএনপির এমপিরা কেন সংসদে গিয়েছিলেন, কেন এখন বেরিয়ে এলেন; কোনোটারই কোনো ব্যাখ্যা নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি দাবি করলো, রাতের ভোটে নির্বাচিত এই সংসদের কোনো বৈধতা নেই। তাই তারা এই অবৈধ সংসদে যোগ দেবেন না।

সংসদ শুরুর পরের ৮৯ দিন তারা যোগ না দেওয়ার কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু ৯০তম দিনে, যেদিন যোগ না দিলে তাদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে; সেদিন সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলনের যুক্তিতে তারা সংসদে যোগ দিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হয়েও মির্জা ফখরুল সংসদে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। কিছু যোগ দিলেন, একজন বিরত থাকলেন; কেন কেউ জানে না।

আমার মনে হয়েছে, সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার লোভেই তারা সংসদে গেছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সংসদে গেলে তারা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি, প্লট, বেতন-ভাতা নিতেন না। সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলনের যে যুক্তিতে তারা সংসদে যোগ দিয়েছিলেন, তার পরিস্থিতি তো বদলায়নি কিছুই। তাদের কি আর সংসদের ভেতরে আন্দোলন করার দরকার নেই?

বিএনপি গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করতে রাজি হওয়ার পর ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নয়াপল্টন থেকে গোলাপবাগ যাওয়ার মাধ্যমে বিএনপির অর্ধেক পরাজয় হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নিজেই এই খেলায় একটি পক্ষ। সেখানে ওবায়দুল কাদেরের এভাবে ফলাফল ঘোষণা করাটা হাস্যকর ঠেকেছে। মাঠের খেলা হোক আর রাজনীতির খেলা হোক; খেলার মাঠটা দুই পক্ষের জন্য সমতল হতে হয়। কিন্তু এখানে তো বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ নয়, ছিল পুলিশ।

সরকার অনুমতি না দিলে বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে পারবে না, এটা সবাই জানে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, দলীয় কার্যালয় দখল করে বিএনপিকে গোলাপবাগে যেতে বাধ্য করে তাদের ‘অর্ধেক পরাজয়’ ঘোষণা করাটা আসলে হাস্যকর। এখন কেউ যদি তর্কের খাতিরে ওবায়দুল কাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিতে না পারাটা কি সরকারি দলের অর্ধেক পরাজয়? কী জবাব দেবেন তিনি।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম