এখন নদীটির মধ্যখানে চর ভেসে উঠেছে। চরের ওপর ঘর-বাড়িও হয়েছে। তেমন উঁচু নয়। কারণ নদীর তীব্র ঢেউ কিংবা বর্ষায় ছোট্ট টিলার মতো দ্বীপগুলো ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। পূর্ব পাশের ছোট্ট বাজারখানা আজ অনেক বড়। কী নেই এই বাজারে? বাজারটার কারণে এলাকাকে এক প্রকার মফস্বলই বলা যায়। নদীর পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাজারের দালানগুলোয় শ্যাওলার আস্তরণ পড়েছে। শীতকালে অবশ্য দেওয়ালের গায়ে পানি লাগে না। তবে বর্ষাকালে কিছু অংশ পানিতে ঢাকা পড়ে। দেওয়ালগুলো দেখলে মনে হয়, একই দেওয়ালে বর্ণবৈষম্য। বাজারের একপাশে পাশাপাশি দুটি ঘাট আছে। একটি লঞ্চঘাট অন্যটি নৌকার। অবশ্য নৌকা বললে ভুল হবে। ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঘাট। পশ্চিম পাশে বাঁধ। একসময়ের এই খরস্রোতা নদীর আক্রোশ থেকে বাঁচার জন্যই এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। নতুন কেউ এলে বলবে, ‘কী দরকার ছিল এই মরা নদীর জন্য বাঁধ তৈরি করার?’ তবে এক সময় এই নদী জ্যান্তই ছিল। স্রোতের তোড়ে দু’চার গ্রাম ভাসিয়ে দিয়ে যৌবনের তীব্র তেজের প্রমাণ দিতো। আশেপাশে গড়ে ওঠা জেলেপাড়ার মানুষগুলো এই নদী নিয়েই সুখে ছিল। কারণ তাদের জীবনধারণের জন্য যে জোগান প্রয়োজন, তা এই নদীই তাদের মিকাঈলের হাতে দান করতো। যদিও রাক্ষুসে নদীর আগ্রাসনে প্রায়ই তাদের সর্বস্ব বিলীন হয়ে যায়। তারপরও নদীই তাদের জীবন। তারা বিশ্বাস করতো, নদীর রক্ষিত সম্পদ তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে আবার সেই নদীই যদি সব নিয়ে যায়, তাতে অভিমানের কিছু নেই।
Advertisement
রফিক মিয়া। গ্রামের জেলেদের সর্দার। যদিও নদীতে আগের মতো এখন মাছ পাওয়া যায় না, তারপরও সে সর্দার। এক সময় এই নদী যখন তার ঐশ্বর্য দিয়ে দুই পাড়কে সমৃদ্ধ করতো অথবা অভিশাপ দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতো সেই সময়টাতেই জন্ম রফিকের। তার বাবাও জেলে ছিল। তখনকার জেলেপাড়া মাছের আঁশটে গন্ধ, জাল শুকানোর দৃশ্য, জেলেদের ছোট ছেলেমেয়েদের কর্দমাক্ত শরীরে ছোটাছুটি ইত্যাদি দ্বারা বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত ছিল। এখন মাছর গন্ধের পরিমাণ কমে গেলেও দু’চারটা ছেড়া জাল শুকাতে দেখা যায়। দেখা যায় ল্যাংটি পরিহিত জেলে সন্তানের ছোটাছুটি। রফিকও এই কর্দমাক্ত শরীরে বড় হয়েছে এই ধনাগোদা পাড়ের জেলেপাড়ায়। বয়স যখন তেরো কি চৌদ্দ, তখন থেকেই তার বাবার সাথে মাছ ধরতে নদীতে যেত। সারারাত মাছ ধরে সকালে বাজারে বেচতে হতো। একদিন তার মা তার বাবাকে বলেছিল, ‘এই রাইত বেরাইতে পোলাডারে লইয়্যা যান? আমার ডরই করে। আর একটু বড় অইলে যাউক না?’রফিকের বাবা ঘামার্ত মুখখানা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে কিঞ্চিত হেসে বলে, ‘কী যে কও রফিকের মা? নদীই যাগো বাঁচন, নদীই যাগো মরণ; হেগো আবার ডর কিয়ের? তাছাড়া পোলাতো আর ডাকতোর-এঞ্জেনিয়ার অইতো না। হেই মাছ ধইরাই খাইতে অইব। অহন থেইক্যা গেলেই সাহস অইব।’রফিকের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয় নদীর বেপরোয়া স্রোতের বিপরীতে রফিকের সংগ্রমী জীবনের চূড়ান্ত অভিযান। বছর দুয়েক পরই রফিককে টেক্কা দিতে আর্শীবাদপুষ্ট নদী রাক্ষসীতে রূপ নেয়। অন্য সবার মতো তারও হারিয়ে যায় অনেক কিছু। ভিটে-মাটি, স্বজন সবকিছু। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় রফিক। সেদিন রফিক রাগে-অভিমানে এই নদীকে কত গালিই না দিয়েছে।
তারপর থেকে নদীতে আর কোনো বড় স্রোত দেখা যায়নি। দুই পাড়ে বিশাল চর ফেলে মৃত প্রায় সে। যেন রফিকের অভিশাপই লেগেছে তার ওপর। রফিক এখনও জেলে। নদীর জলের সাথে সাথে মাছের ভাটা পরায় আয় কমে গেলেও পদবিটা বহাল আছে। এখন দু’মুঠো ভাত জোটাতে আগের চেয়ে বহু কষ্ট হয়। তার একটা ছেলে আছে। এ বছর ক্লাস টেনে পড়ে। বেশ ভালো ছাত্র। স্কুলের জামাটায় কতটা তালি পড়েছে হিসেব নেই। তারপরও কোনো বায়না নেই। সে জানে অভাবের সংসারে বায়নাটা নিস্ফল। স্কুলে ভালো ফলাফল করলেও নেই তার জন্য শুভ কামনা। এই তো গত বার্ষিক পরীক্ষায় যখন ফার্স্ট হয়ে বাড়ি যাচ্ছিল পথে শুনতে পায়, একজন শিক্ষক তার এক সহপাঠীকে ঝাড়ি দিয়ে বলতেছে, ‘জাইল্যার পোলায় ফার্স্ট হয় কেমনে?’ আবার যখন জেলেদের জন্য দেওয়া সরকারি রিলিফ আনতে যায়, তখন চার-পাঁচটা পুকুরে মাছ চাষকারী মোমেন হাওলাদার বলে, ‘তুই রফিক্কা জাইল্যার পোলা না?’রফিকের কিশোর ছেলে নিশ্চুপ বাড়ি আসে। আসতে আসতে ভাবে, যারা ছেড়া জালে সারাদিন চেষ্টা করে পুঁটি মাছ জোটাতে পারে না; তাদের পদবি ‘জাইল্যা’। আর যারা বড় বড় পুকুর চাষ করে কিংবা মাছের আড়তের মালিক তারা মাছ ব্যবসায়ী। আবার জেলে বলে গালি দেয় কেন? মরা নদী পাড়ের জীর্ণ বাসিন্দা বলে? বাড়ি এসে বাবাকে মনের ব্যাথাগুলো খুলে বলে। রফিক নিশ্চুপ বসে থাকে। ভাবে তার শৈশব-কৈশোরের কথা। যখন এই নদীর স্রোতের সাথে তাদের ভাগ্যও সজীব ছিল। হউক না যত বিপদ। এখনই বা বিপদ কম কীসে? না খেয়ে ও অপমানে মরার চেয়ে নদীর স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে মরা অনেক ভালো। অবশেষে তার মনে হয় তার মুর্খ জেলে বাবার সেই দার্শনিক উক্তি, ‘নদীই যাগো বাঁচন, নদীই যাগো মরণ; হেগো আবার ডর কিয়ের?’
এখন নদী নাই কিন্তু সংগ্রাম আছে। ছেলের পিঠে রফিক একটু চাপড়ে দেয়। ছেলের অভিমানী চোখে লড়ে যাওয়ার আগুন সে দেখতে চায়। সে বুঝাতে চায়, যার হারানোর কিছু নেই; তার আবার ভয় কীসের? তুই তো জাইল্লার পোলা, এটাই তোর জীবনের মন্ত্র। রোদের তীব্রতা, খরস্রোতা নদীর তেজ, ক্ষুধার যন্ত্রণা আর তিরস্কারের খোঁচা সব সইবার ক্ষমতা তোর রক্তে আছে। এসব কিছুই না। মৌন দার্শনিকতায় ছেলেকে উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালায় রফিক। বাবার চোখের ভাষা যে দুরন্তপনার আশ্বাস, সেটা ছেলে বুঝতে পারে। পিঠ টান করে সে বেরিয়ে পড়ে। অনেক রোদ সহ্য করতে হবে যে!
Advertisement
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসইউ/