আইন-আদালত

মামলাজট নিষ্পত্তির মহাপরিকল্পনা

চলতি বছরকে ‘মামলাজট নিষ্পত্তির বছর’ হিসেবে ঘোষণা করে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিচারক ও এজলাসের সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনবল বৃদ্ধি, আইনের পুনর্বিবেচনা, বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, মামলা ব্যবস্থাপনা ও বিচার প্রশাসনে তদারকি বাড়ানো এবং সেকেলের আইনের বিশ্লেষণ চলছে। সুপ্রিম কোর্টের এ উদ্যোগ সফল হলে দেশের আদালতগুলোর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। এর আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘আপিল বিভাগে গত এক বছরে (২০১৫ সালে) ২শ` ভাগ মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, যে সকল মামলা বছরের পর বছর নিষ্পত্তি হয়নি, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে মামলার পরিমাণ অর্ধেকে কমিয়ে আনা হবে। প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, আমরাও চাই আদালতে মামলাজট কমে আসুক। যে কারণে মামলার জট বাড়ে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হলে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ সফল হবে। এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে এবং আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে।  ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মামলাজট কমানো এবং নিম্ন-আদালতের গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দৈনন্দিন কাজের সময় বাড়ানো, আদালতের অন্তবর্তীকালীন আদেশ দ্রুত নিষ্পত্তি করা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিচারককে কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশনা ও উচ্চ আদালতে অনলাইনে দৈনন্দিন কার্যতালিকা প্রকাশ ও ছুটি কমানো। ওই উদ্যোগের ফলে ২০১৫ সালে সারা দেশের বিচারিক আদালতগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সার্বক্ষণিক তদারকি ও নির্দেশনার ফলে বিচারকদের মধ্যে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির স্পৃহা বেড়েছে। ফলে নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বেড়েছে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ। সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।  পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৩টি মামলা। ২০১৪ সালে এই নিষ্পত্তির সংখ্যা ছিলো ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৬৫২টি। ওই বছরের তুলনায় গত বছর ৭০ হাজার মামলা বেশি নিষ্পত্তি হয়েছে। এক্ষেত্রে তুলনামূলক নিষ্পত্তির শতকরা হার ১০৭ ভাগ। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মামলার নিষ্পত্তির হিসাব প্রস্তত করা হলে পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে বলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন মনে করেন। এছাড়া ২০১৩ সালে সারা দেশে ১১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৪টি এবং ২০১২ সালে ১০ লাখ ৩২ হাজার ১৮৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১৫ সালে নিম্ন আদালতেও মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেড়েছে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা চার লাখ এক হাজার ৭৭২। এর মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৩১০টি এবং আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে ১২ হাজার ৪৬২টি মামলা। সব মিলিয়ে সারা দেশের আদালতগুলোতে ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৭টি মামলা বিচারাধীন। সারা দেশে নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা এক হাজার ৪৯২ জন।  সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে প্রায় দ্বিগুণ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। হাইকোর্ট এবং নিম্ন আদালতেও মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে নানা উদ্যোগের কারণে এই নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। ফলে কমে এসেছে দীর্ঘদিনের মামলাজট ও বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি। নিষ্পত্তির এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বেড়ে যাবে। হিসাব অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের (২০১৫) জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯ হাজার ৩৫৬টি মামলা। এই সময় দাখিল হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৪৫টি মামলা। অর্থাৎ দায়ের হওয়া মামলার চেয়ে তিন হাজার ৭১১টি মামলা বেশি নিষ্পত্তি করেছেন আপিল বিভাগ। ২০১৪ সালে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৮৯টি ও ২০১৩ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে পাঁচ হাজার ২৩২টি মামলা। ২০১৫ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টে ৩৩ হাজার ৩৮০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এই সময়ে হাইকোর্টে দায়ের হয়েছে ৫২ হাজার ১১২টি মামলা। ২০১৪ সালে ওই পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল ২২ হাজার ৪৭৭টি। ২০১৩ সালে নিষ্পত্তি হয়েছিল ২১ হাজার ৩১২টি। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মূলত, প্রধান বিচারপতির বিচক্ষণ উদ্যোগের কারণেই উল্লেখযোগ্য মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এখানে অান্তরিকতা ও প্রচেষ্টাকে কাজে লাগানো হয়েছে। তিনি বলেন, মামলার শুনানি, নিষ্পত্তির জন্য নথি দ্রুত প্রস্তুত করা ও শাখা থেকে নথি দ্রুত বেঞ্চে পাঠানোর ফলে বিচারপতিরা মামলা দ্রুত শুনানি করেছেন। প্রধান বিচারপতির এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন অন্যান্য বিচারপতিরাও। সুপ্রিম কোর্টে মামলা নিষ্পত্তিতে একাধিক ও বিশেষ বেঞ্চ গঠন এবং তা যথাযথভাবে তদারকি করার কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে বলে মনে করেন সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় গেল বছর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে অধিক ও দ্রুত মামলার শুনানি হয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকটা বেড়েছে। বিভিন্ন বেঞ্চ গঠন, সঠিকভাবে তদারকি বাড়ানাের ফলে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চ আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকা অনুযায়ী মামলার শুনানি হচ্ছে। এতে করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি অনেকটা কমেছে। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করা হয়। সে সময় সারা দেশের আদালতগুলোতে ১৫ লাখ মামলা বিচারাধীন ছিল। উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ছিল দুই লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৭টি। ২০১৫ সালে সাড়ে ১০ লাখ মামলা নিষ্পত্তিতে প্রধান বিচারপতির নানা উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। এফএইচ/এমজেড/একে/পিআর

Advertisement