সময় গেলে অনেক কিছু বদলে যায়। পুরাতনকে ঝেড়ে নতুনের আগমণ ঘটে। দুনিয়াকে শাসন করে। পৃথিবীর নিয়মই এটা। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেই নয় শুধু, প্রকৃতিতে সব কিছুর সঙ্গেই এই নিয়ম জড়িত। এ থেকে দুরে যাওয়ার সুযোগ কারো নেই।
Advertisement
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরও সময় বুঝি ফুরিয়ে এলো! এবার বুঝি তার বিদায় নেয়ার পালা! ২০০৩ সালে যখন আন্তর্জাতিক ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, তখনকার পর্তুগিজ দলে ছিলে লুইস ফিগোর মতো বিশ্ব তারকা। ছিলেন বার্সার ডেকো। ছিলেন রুই কস্তা, নুনো গোমেজ, পওলেতা, সিমাও, রিকার্ডো কার্ভালহোর মত তারকা ফুটবলাররা।
তখনও বিশ্বফুটবল শাসন করছিলেন ব্রাজিলের রোনালদো, রোনালদিনহো, রবার্তো কার্লোস, ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যামের মত ফুটবলাররা। ব্রাজিলের রোনালদোর রাজত্বে পর্তুগালের আরেক রোনালদোর আগমণে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন।
কিন্তু তার অসাধারণ গতি আর ড্রিবলিং- মুহূর্তেই মুগ্ধ করে দিয়েছিলো সবাইকে। ২০০৪ উইরোর কথা মনে আছে। লুইস ফিগোদের সঙ্গে লম্বা, লিকলিকে গড়নের তরুণ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর গতি, ড্রিবলিং আর গোল করার অসাধারণ দক্ষতা দেখে অনেকেই তখন তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন।
Advertisement
এরপর পর্তুগাল এবং বিশ্ব ফুটবলে আরও অনেক তারকা এলেন-গেলেন; কিন্তু প্রায় ২০ বছর ধরে একই ছন্দে, একই গতিতে ফুটবল খেলে যাওয়ার মত ফুটবলার বিশ্ব ফুটবলও খুব কম পেয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর চির প্রতিপক্ষ লিওনেল মেসিও আন্তর্জাতিক ফুটবলে এসেছেন তার দুই বছর পর, ২০০৫ সালে।
পর্তুগালের হয়ে খেলেছেন ১৯৫টি ম্যাচ। এখনও পর্যন্ত গোল করেছেন ১১৮টি। পেলে-ম্যারাডোনাদের অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছেন সিআর সেভেন। লুইস ফিগোদের সোনালি প্রজন্ম যেটা পারেননি পর্তুগালকে সেটা উপহার দিয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে জিতিয়েছেন ইউরোর মুকুট। অথচ, ২০০৪ সালেও ইউরোর ফাইনাল খেলেছিলো পর্তুগাল। কিন্তু শিরোপা জিততে পারেনি।
ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে বহু আগেই পর্তুগিজ কিংবদন্তি ইউসেবিওকে পার হয়ে গিয়েছিলেন। মেসির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিতেছেন ব্যালন ডি’অর, ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার। ৫টি ব্যালন ডি’অর উঠেছে তার হাতে। বলা হয়ে থাকে, ২০১৮ সালে রিয়াল মাদ্রিদ না ছাড়লে হয়তো তার ব্যালন ডি’অর হতো ৬টি।
৫টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করা একমাত্র ফুটবলার তিনি। ইউরোপের সেরা ৫ লিগের মধ্যে তিনটিই জয় করার কৃতিত্ব রয়েছে তার। গোলের পর গোল করে যিনি প্রতিবারই ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটের অন্যতম দাবিদার হয়েছিলেন, সেই রোনালদোর সূর্য মধ্যগগণ ছেড়ে কবে যে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে, তা হয়তো এতদিন বুঝতে পারেননি সিআর সেভেন।
Advertisement
এবার বুঝতে পেরেছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে অন্তত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার জন্য অন্য যে কোনো ক্লাবে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে নিতে রাজি হয়নি। বুড়ো সিংহকে কে আর পালতে চায় বলুন!
এর মধ্যেই তার নিজের মধ্যে তৈরি হয়েছে প্রচণ্ড জাত্যাভিমান, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা, সেখানে ভাটা পড়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না। সে কারণেই ক্লাবে কিংবা জাতীয় দল- সব জায়গাতেই কোচের সঙ্গে ঝামেলা বেধে যাচ্ছে রোনালদোর।
ক্লাব ফুটবলে কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসলেও অনেকে এ ক্ষেত্রে রোনালদোকে দায়ী ভাবেননি। কিন্তু বিশ্বকাপে এসে যখন কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন, ব্রুনো ফার্নান্দেসের গোলকে নিজের বলে দাবি করেছেন, তখন সবাই বুঝতে পেরেছে আসল ব্যাপারটা।
রোনালদো নিজে যে ফুরিয়ে যাচ্ছেন- তিনি তা এখনও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন না। করেন না বলেই কোচ যদি তাকে মাঠ থেকে তুলে নিতে চান, তখন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। কোচের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেন। যে কারণে দলের সতীর্থদের সঙ্গেও তার মানসিক দুরত্ব রয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
তবে, রোনালদোর সূর্য যে ডুবতে চলেছে, তা স্পষ্ট বোঝা গেলো- কাতার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। কোচ ফার্নান্দো সান্তোস রোনালদোর মত ফুটবলারকে বসিয়ে রাখলেন সাইডবেঞ্চে। রীতিমত অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য। ২০ বছরের ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে এসে রোনালদোকে এ দৃশ্য হজম করতে হবে! তা আসলেই অবিশ্বাস্য।
অথচ সেটাই ঘটেছে। ফার্নান্দো সান্তোস শুরুতে কম সমালোচিত হননি। কিন্তু রোনালদোকে বসিয়ে রেখে মাঠে নামানো গনকালো রামোস যেভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন, তাতে কোচ তো নিজে বেঁচে গেছেনই, সঙ্গে রোনালদোর ক্যারিয়ার যে এখানেই শেষ হয়ে গেলো, তা স্পষ্ট হয়ে গেলো।
২০০৮ সালের ইউরো থেকে শুরু। রোনালদো ছিলেন পর্তুগালের স্টার্টিং লাইনআপের অপরিহার্য সদস্য। এর মধ্যে তিনটি বিশ্বকাপ, তিনটি ইউরো, দুটি উইয়েফা নেশন্স লিগ পার হয়ে গেলো। অথচ, এই প্রথম রোনালদো পর্তুগালের স্টার্টিং লাইনআপে ছিলেন না।
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে গনকালো রামোস করলেন অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক। রোনালদোর পরিবর্তে মাঠে নেমেই বাজিমাত করলেন বছর ২১-২২ এর এই তরুণ। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে স্কোরলাইন ৬-১। বিশাল এক জয়। এতবড় স্কোরশিট, অথচ সেখানে নাম নেই রোনালদোর। স্মরণাতীতকালে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা হয়েই থাকলো পর্তুগালের জন্য।
ফার্নান্দো সান্তোস একধরনের জুয়া খেলেছিলেন রোনালদোকে বসিয়ে রেখে এবং রামোসকে নামিয়ে। এই জুয়ায় তিনি জয়ী। রোনালদোকে ছাড়াই ৫-১ ব্যবধানে এগিয়েছিল পর্তুগাল। রোনালদো নামার পর আরও এক গোল হলো। কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের কাছে প্রমাণ হলো, রোনালদো ছাড়াই তিনি এখন চলতে পারবেন। তার দলের তরুণ তারকারাই এখন সাফল্য এনে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানে বুড়ো রোনালদো এখন কেবলই বোঝা! তার নাম আর খ্যাতিই আছে কেবল, মাঠে দেয়ার মত কিছুই নেই।
কিন্তু ম্যাচের ৭৩তম মিনিটে গনকালোকে বসিয়ে যখন রোনালদোকে মাঠে নামালেন কোচ সান্তোস, তখন পুরো লুসাইল স্টেডিয়াম গর্জনে প্রকম্পিত। পর্তুগালের ৬ গোলে যতটা না কেঁপেছে, তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি আওয়াজে কেঁপেছে পুরো স্টেডিয়াম, সবগুলো গ্যালারি। দর্শকরা হয়তো মেনে নিতে পারছেন না, রোনালদো এখন মাত্র ২০ মিনিটের ফুটবলার। তারা গগনবিদারি চিৎকারে স্বাগতম জানালো সিআর সেভেনকে।
কোচের বাতিল তালিকায় চলে যেতে পারেন সিআর সেভেন, কিন্তু ভক্ত-সমর্থকদের হৃদয় থেকে তো আর তাকে মুচে ফেলা যাবে না। ৩৮ বছর বয়সেও তাই তিনি সমান তালে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন ফুটবলের সবুজ গালিচা থেকে সমর্থকদের হৃদয়ে।
আইএইচএস/