মারুফা জাহান মাইশা। পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশু। কুড়িগ্রামের এই শিশুটির ৯ মাস বয়সে পুড়ে যাওয়া আঙুলের অপারেশন করাতে অনেক আশা নিয়ে ঢাকা শহরে নিয়ে আসেন মাইশার বাবা-মা। এবং আমি এটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সহজ সরল এই পরিবারটি কোনো না কোনো দালালের খপ্পরে পড়ে আজকে তাদের আদরের দুলালীকে হারিয়েছেন।
Advertisement
ঘটনার পেছনের ঘটনা হচ্ছে মিরপুরের রূপনগরে অবস্থিত আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সুস্থ সবল শিশু মাইশা। অপারেশনের দিনক্ষণ ঠিক করে নির্ধারিত দিনে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার জানান যে, মাইশার অবস্থা খারাপ এবং তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। সেই মোতাবেক তারা তড়িঘড়ি করে তাদের মিরপুরের আরেকটি হাসপাতালের আইসিইউতে পাঠিয়ে দেয়, যেখানে যাওয়ার পর জানা যায় মাইশা মারা গেছে।
বাস্তবে আইসিইউ’র নাম করে মরদেহটি হাসপাতালের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানে প্রশ্ন আসে, কেন তারা দায়িত্ব না নিয়ে বা আইসিইউ না থাকা একটি হাসপাতালে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলো? অপারেশনের যেকোনো মুহূর্তেই একজন রোগীর অবস্থা খারাপ হতে পারে এবং আইসিইউ’র প্রয়োজন লাগতে পারে। তাহলে কেন তারা সেটি আগে ভাবেনি?
মরদেহ গোসল করানোর সময় ঘটে সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয়টি। অপারেশন হওয়ার কথা হাতের আঙুলের অথচ মাইশার পেটে এ মাথা থেকে সে মাথায় কাটা দাগ ও সেলাই করা। সংবাদ মাধ্যমের তদন্তমূলক প্রতিবেদন বিশেষজ্ঞদের বরাদ দিয়ে বলছে যে, অনেক সময় পোড়া জায়গা পূর্ণ করার জন্য শরীরের অন্য অংশ থেকে চামড়া নেওয়া হতে পারে কিন্তু তাই বলে গোটা পেট কাটার কথা নয়। এখানেই আসল প্রশ্নটুকু। কেন তাহলে মাইশার গোটা পেট কাটা হয়েছিল? মাইশার বাবা-মা’রও একই প্রশ্ন। কেন কাটা হয়েছিল পেট? পেট কাটার আগে কি অভিভাবকদের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল? না হয়ে থাকলে কেন? এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত ডাক্তার একা নিতে পারেন কি? সে কেমন ডাক্তার?
Advertisement
একটি অনলাইনের প্রতিবেদন বলছে, যে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মাত্র তিনমাস আগে। সেখানে এখনও কোনো কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়নি। অপারেশন থিয়েটারের পুরোপুরি সেটাপও নেই। কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্যানেল নেই। কর্মী সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন। হাসপাতালের নেই কোনো রেজিস্ট্রেশন বা আইনি কাগজই তারা দেখাতে পারেনি।
বিল্ডিংয়ের অর্ধেক অংশজুড়ে গড়ে তোলা এই হাসপাতালটির প্রায় সবকিছুই ফাঁকা। কোন রোগী নেই। সম্প্রতি এর মালিকানাও পরিবর্তন হয়েছে বলে রিপোর্ট বলছে। এখানেও প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটি অব্যবস্থাপনার মধ্যে সেই হাসপাতালে কেমন করে অপারেশন করতে পারে? সেই ডাক্তার কেন এটা করলো আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেনই বা এটি করতে দিলো? কী তাদের উদ্দেশ্য?
মালিকের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ডা. আহসান হাবীব চেম্বার করেন অন্য জায়গায় কিন্তু কোনো রোগীর অপারেশন থাকলে মাঝে মাঝেই এখানে নিয়ে এসে করেন। অবাক হওয়ার মতোই তথ্য। যে হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন নেই, সেটআপ নেই, যন্ত্রপাতি নেই, কর্মকর্তা, কর্মচারী কিছুই নেই সেই হাসপাতালে অপারেশনের জন্য নিয়ে আসে? এতো সাক্ষাৎ জমের ঘর মনে হচ্ছে। ডেকে নিয়ে মানুষ হত্যা অথবা মানুষ নিয়ে ব্যবসার ফাঁদ।
রিপোর্ট হওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালটি বন্ধ ঘোষণা করেছে। খুব ভালো কথা কিন্তু কথা হচ্ছে অনুমতির আগে কেমন করে শহরের মধ্যে থাকা একটি হাসপাতাল কার্যক্রম শুরু করে দিতে পারে তাও অপারেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এগুলো দেখার কি কেউই নেই? ২০২০ সালে দেশে করোনা শুরু হওয়ার পর বহু ভুয়া হাসপাতালের সংবাদ আমরা পেয়েছিলাম। ভুয়া ডাক্তারের খোঁজও আসে প্রায়শই। তখনও এমন কিছু হাসপাতালকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মালিকদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি ভুয়া ডাক্তারি বা অনুনোমোদিত হাসপাতাল কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। শিশু মাইশার মতো আর কত জীবনের বিনিময়ে আমাদের কর্তৃপক্ষ শক্ত হবেন? নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু খুব একটা কঠিন কিছু নয়। মনিটরিং জোরদার করলেই সম্ভব এদের আয়ত্তে নিয়ে আসা।
Advertisement
সংবাদে আরও জানা গেছে যে, ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা মাইশার বাবা-মাকে মীমাংসার জন্য বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও লোভ দেখাচ্ছে। আমি স্যালুট জানাই মাইশার বাবা-মাকে। তারা টাকার বিনিময়ে আপসের রাস্তা মেনে নিচ্ছে না। সন্তানের জীবনের কোনো বিনিময় হতে পারে না। জেনেবুঝে হত্যার কোনো রক্ষা হওয়া উচিত নয়। তারা ইতিমধ্যে দাবি করেছে, সংশ্লিষ্টদের উপযুক্ত বিচারের। কেন মাইশার পেট কাটা হলো এর উত্তর তাদের চাই।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই লুকিয়ে আছে বাকি অনেক কিছুর উত্তর। কে জানে এই পেট কাটার ব্যবসা তারা কতদিন ধরে করে আসছেন? পেট কেটে সেলাই করে দিলেই কি বিচারের দাবিকে ভেতরে ফেলে রাখা যাবে? উন্মুক্ত হোক মাইশার পেট কাটার রহস্য। আর উপযুক্ত শাস্তির নিশ্চয়তাই পারে আগামীর স্বাস্থ্যখাতকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম