দেশজুড়ে

ভিত্তি স্থাপনের ৫ বছরেও শুরু হয়নি হাসপাতাল নির্মাণ

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অভিভাবকত্ব হীনতায় পিছিয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ (কমেক)। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছরেও হাসপাতাল পায়নি মেডিকেল কলেজটি। পাঁচ বছর আগে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হলেও এখনো শুরু হয়নি নির্মাণ কাজ। ফলে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন কক্সবাজারের ২৮ লাখ জনগণ ও বেড়াতে আসা অগণিত পর্যটক। কাটছে না শিক্ষক ও কর্মচারী সংকটও। এতে ব্যাঘাত ঘটছে পাঠদান এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের একটি ছোট ইউনিটে ২০০৮-২০০৯ সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কমেকের যাত্রা। কিন্তু ১৪ বছরেও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়নি। ২০১৭ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করলেও অদ্যাবধি নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। সদর হাসপাতালে শয্যার অভাবে প্রায়ই মেঝেতে থেকে রোগীদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। একটু জটিল সমস্যা নিয়ে এলেই তাকে পাঠানো হচ্ছে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায়। এতে পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটছে।

২০১০ সালের নভেম্বরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কক্সবাজার সদর হাসপাতালকে অস্থায়ী কমেক হাসপাতাল ঘোষণা করে। প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ডা. বি এম আলী ইউসুফ বদলীর পর যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা ভবনের অস্থায়ী ক্যাম্পাসটিও মূল ক্যাম্পাসে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। অথচ ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের ভিত্তি স্থাপন করেন।

২০১১-২০১২ সালে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার জানারঘোনা এলাকায় ৩৩ একর জায়গায় কমেক স্থায়ী ক্যাম্পাসের অবকাঠামো তৈরি হলেও নির্মাণাধীন কলেজ ও হোস্টেলের নতুন ক্যাম্পাস ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের মূল পরিকল্পনায় সীমানা প্রাচীর ও শহীদ মিনার ছিল না। ছিল না বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ, গভীর নলকূপ, ভবনের বিদ্যুতের ওয়ারিং, জানালার কাঁট, ফ্লোরের টাইলস ফিনিসিং, লিফট সংযোজন। নতুন ক্যাম্পাস যেন ভুতুড়ে বাড়ী, পরিত্যক্ত ভবন। বখাটের আড্ডা, গবাদি পশু বিচরণ ছিল চারপাশে। কলেজের জায়গার ৩৪ শতক জমি ছিল অধিগ্রহণহীন। হোস্টেল না থাকায় পাঁচটি ভাড়া বাড়িতে অবস্থান ছিল শিক্ষার্থীদের। ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করান কলেজের কার্যক্রম। ক্যাম্পাসে শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী, শ্রেণিকক্ষ, হোস্টেলের প্রয়োজনীয় আসবাব ও অন্য সরঞ্জাম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই দরপত্র আহবান করে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ সময় অস্থায়ী কমেক হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল শিক্ষকদের জন্যও শিক্ষা সামগ্রী নেওয়ার ব্যবস্থা করেন অধ্যক্ষ।

Advertisement

২০১৭ সালের ৬ মে কমেকের স্থায়ী হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করাতে সক্ষমহন অধ্যক্ষ রেজাউল। কিন্তু দরপত্র মতে প্রয়োজনীয় আসবাব ও মেশিনারি বুঝে নেওয়ার আগেই তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান (২৯ জুন ২০১৭)। এরই মধ্যে অনিয়মের অভিযোগে অধ্যক্ষসহ কয়েকজন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়। এতে অভিযোগ করা হয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত মালামাল অর্ডার করা ও নিম্নমানের আসবাব নেওয়া হয়েছে। অথচ এসব মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে তার অবসরের মাস দুয়েক পর। এত রশি টানাটানির পর তার পরবর্তী কোনো অধ্যক্ষ কলেজ হাসপাতাল কিংবা অন্যকোন উন্নয়ন কাজে হাত দেয়ার সাহস করেননি। ফলে পিছিয়ে আছে কমেক।

কলেজ সূত্র জানায়, মেডিকেল কলেজে একজন অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৮৯টি শিক্ষকের পদ আছে। ২০১৬ সালে মাত্র ৪২ জন শিক্ষক দিয়ে যাত্রা হয়- যাদের অধিকাংশ প্রভাষক। এখনো ১৫টি পদে মাত্র দুজন কর্মরত, বাকি পদ শূন্য। সহযোগী অধ্যাপকের ২৩ পদে আছে ৯ জন, সহকারী অধ্যাপকের ২৪ পদে ২৪ জন এবং লেকচারার ২৪ জনই আছেন। ওএসডি মূলে ২৩ জন সহকারী অধ্যাপককে কলেজে সংযুক্তি দিলেও মূলত জুনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে কলেজটির কার্যক্রম জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এরপরও সাম্প্রতিক ফাইনাল পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৪ মেডিকেল কলেজে পাসের হারে শীর্ষে ছিল কমেক।

এছাড়া কমেকের শুরু থেকেই কর্মচারীর তীব্র সংকট ছিল যা এখনো বিদ্যমান। রাজস্ব খাতে ৩৪টি তৃতীয় শ্রেণী পদ তৈরি হলেও এক চিঠির মাধ্যমে তা ২৪ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২৪ জনেও কর্মরত পাঁচজন, একজন সংযুক্তি, আরেকজন প্রেষণে কাজ করছেন। আর আউটসোর্সিং ৪৫ পদ তৈরি হলেও তাও কমিয়ে ২০ জনে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। কর্মচারীর পদ অদ্যাবধি শূন্য থাকায় কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। ১০ তলার একাডেমি ভবনে ৬ তলা পরিপূর্ণ হলেও বাকি আছে আরও চারতলা নির্মাণ। দুটি হোস্টেল ছয় তলা করে হওয়ার কথা থাকলেও তিনতলা করেই ফেলে রাখা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে অবস্থান করতে হয়।

অপরদিকে, মহাসড়ক থেকে ৯২০ ফুট দূরত্বে কলেজের ক্যাম্পাস পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে কাঁটাতারের বেড়া বা দেওয়াল না থাকায় নিত্যদিন যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং ও বখাটেদের উৎপাত থাকে। দুপাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা।

Advertisement

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন দুপুরে আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিবেন তিনি। এর আগে উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধন করবেন। এ সময় দাবির তালিকায় কমেক হাসপাতাল নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। ৫ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নতুন যেসব প্রকল্প দাবি করা হয়েছে সেখানে কমেক হাসপাতালটিও স্থান পেয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার আগমনে আমাদের বেশ কয়েকটি আবেদন আছে। এর মধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি প্রধান দাবি হিসেবে থাকবে। এটি জেলাবাসীর প্রাণের দাবি।’

সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রজন্মের জন্য ভালো চিকিৎসক গড়তে কমেকের জন্য যা ভালো তা-ই করার চেষ্টা করেছিলাম। মেডিকেলের শিক্ষা কার্যক্রম নিত্য পরিবর্তনশীল ও প্রশিক্ষণে নতুন টেকনোলোজির সংযোজন হচ্ছে। মেডিকেলে তৃতীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার সমান গুরুত্ব আছে। কলেজ ও হাসপাতাল আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ না হলে শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকরা অনেকাংশে পিছিয়ে যায়। তাই মেডিকেলে বরাদ্দের সিংহভাগ কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়। শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকদের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের কথা বিবেচনা করে দক্ষ চিকিৎসক হিসাবে গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতির কার্যাদেশ দিয়েছিলাম। সে কার্যাদেশের বিপরীতে প্রশাসনিক অনুমোদন ছিল। কিন্তু অবসরের পর যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হয়রানি ছাড়া কিছু নয়। আর্থিক কোনো লেনদেন নেই, শুধু অতিরিক্ত আসবাব ও যন্ত্রপাতির পার্সেস অর্ডার কেন করেছি, তা নিয়েই হয়রানি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কক্সবাজারের বড় ইস্যু রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসা সেবায়। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেক। তাই কমেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ হলে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের সেবা বাড়বে। চিকিৎসা জট কমবে সদর হাসপাতালে।’

কমেক অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, অবহেলিত কক্সবাজারের চিকিৎসায় কী দরকার তা লোকাল হিসেবে অনুধাবন করতে পারায় প্রফেসর রেজাউল করিম কমেকে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করেছিলেন। যা রোহিঙ্গাদের রোগ নির্ণয় ও কোভিডকালীন মাতৃদুগ্ধের মতো কাজ করেছে। ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রাম উপলক্ষে আসা শৃঙ্খলাবাহিনী ও রাজনীতিবিদের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীল এক হাজার ৪৬৫ জন ৫ ডিসেম্বর একদিনেই কোভিড পরীক্ষা করিয়েছে কমেক থেকে। যা সারা দেশে বিরল। কমেক হাসপাতালটি পূর্ণতা পেলে এখানকার চিকিৎসা সেবা বহুলাংশে এগিয়ে যাবে। এসব বিষয় তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ভুল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) কারণে কমেকের হাসপাতাল নির্মাণটি অর্ধযুগ ধরে পিছিয়ে আছে। বৈদেশিক সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তই এ হাসপাতাল প্রকল্প পেছানোর মূল কারণ। তবে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরিতে একটি মেডিকেলে পরিপূর্ণ হাসপাতাল অপরিহার্য। আমরা বসে নেই- কক্সবাজারসহ আরও চারটি হাসপাতাল জিও ফান্ডে সম্পন্ন করতে ডিপিপি এরইমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাশ হয়েছে। একনেকে পাশ হলেই, শিগগির হাসপাতাল নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া হবে।

এসজে/জেআইএম