ফিচার

সরদার কলোনি: রাজধানীতে ব্যাচেলররা যেখানে স্বাধীন!

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

Advertisement

সময়টা ২০১৫ সাল, চাকরির উদ্দেশ্যে গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুরে নানান অনিশ্চয়তা সঙ্গী করে ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরদার কলোনির ‘১৩৫/এফ’ ভবনে চাচার সঙ্গে একটি রুমে ওঠেন ধ্রুব। গ্রামে থাকতে শহরমুখী পরিচিতজনের কাছে শুনেছিলেন, ‘সরদার কলোনি ফেনীর মানুষের ঘাঁটি’। নিজ এলাকা ছেড়ে অতদূরেও যে নিজ ভাষাভাষী মানুষ পাবেন এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন ধ্রুব। কিছুদিন থাকার পর বুঝতে পারেন, শুধু ফেনী নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য ব্যাচেলর তরুণ, মধ্যবয়সী পুরুষ থাকেন এখানে। ভবনগুলো দেখতে অনেকটা তার কলেজের হলের মতো! বেশ ভালো লেগে যায় ধ্রুবর। সেই থেকে আজ প্রায় সাত বছর হতে চললো একই ভবনেই আছেন, তবে রুম পরিবর্তন করেছেন।

রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত মতিঝিল, সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য অফিসে কর্মরত হাজারো ব্যাচেলর থাকেন সরদার কলোনিতে, প্রায় তিন হাজার ব্যাচেলর এই মেস এলাকায় থাকেন বলে ধারণা করা হয়। শুধু চাকরিজীবী ব্যাচেলরই নন, এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ছাত্র। ঘরভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয় কম হওয়ায় ছাত্রদের পছন্দের মেস এলাকা এটি।

সরদার কলোনির ‘১৩৫/জি’ ভবনে থাকেন খালিদ হাসান। খালিদ জানান,‘২০১৮ সাল থেকে আমি এখানে থাকছি, ডিপ্লোমা শেষ করে বিএসসিতে ভর্তি ও পাশাপাশি চাকরির লক্ষ্যে যখন ঢাকায় এসেছি, তখন থেকে রুম ভাড়া ইউটিলিটি বিল খুব একটা বাড়েনি, থাকা-খাওয়ার খরচ মিলিয়ে মাসে ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। অন্য এলাকার মেসগুলোতে যেমন ব্যাচেলরদের রাত করে রুমে ফেরার জন্য বাড়িওয়ালা কর্তৃক বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয় এখানে তেমনটা নেই, দায়িত্বরত পাহারাদার এবং কেয়ারটেকারদের সঙ্গে সবার আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে’।

Advertisement

কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে এগিয়ে গেলে হাতের ডানপাশে একটি সরু গলি ঢুকেছে, ওটা ধরে একটু এগোলেই দেখা যায় ১৩৫ নম্বর প্লটে আটটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। ভবনগুলো যথাক্রমে, ১৩৫ (৪ তলা), ১৩৫/এ (৩ তলা), ১৩৫/বি (৮ তলা), ১৩৫/সি (৬ তলা), ১৩৫/ডি (৫ তলা), ১৩৫/ই (৪ তলা), ১৩৫/এফ (৫ তলা), ১৩৫/জি (৫ তলা) নামে পরিচিত। এ ভবনগুলোরই সম্মিলিত নাম সরদার কলোনি। প্রতিটি ভবনে বিভিন্ন আকারের রুম রয়েছে। এসব রুমে আকারভেদে দুই থেকে পাঁচজন থাকতে পারেন। প্রতিটি ভবনের প্রতি তলায় টয়লেট, গোসলখানা এবং রান্নাঘর রয়েছে। প্রতিটি রুমের আকার বিভিন্ন রকমের হলেও নকশা একই ধরনের। প্রত্যেকটি ভবনের মাঝে রয়েছে বর্গাকার খোলা জায়গা। রুমের ভাড়া সর্বনিম্ন ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রত্যেক ভবনের দায়িত্বে একজন কেয়ারটেকার আছেন।

সরদার কলোনিতে ২২ বছর ধরে মুদি দোকান পরিচালনা করছেন স্থানীয় শেখ মোঃ আবু জাফর। কলোনির ইতিহাস সম্পর্কে জাফর বলেন, এ জায়গাটির মালিক ছিলেন আফির উদ্দিন সরদার। তিনি ছিলেন বিশ শতকের চল্লিশের দশকের ঢাকা পঞ্চায়েতের বাইশ সরদারের একজন। প্রথমে কাঁচা ও আধাপাকা ঘর তৈরি করে ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতেন। আফির উদ্দিন সরদারের ৮ ছেলে এবং ভবন সংখ্যাও ৮। তার মৃত্যুর পর ছেলেরা বর্তমান ভবনগুলো তৈরি করেন, যা বর্তমানে সরদার কলোনি নামে বহুল পরিচিত। কলোনির বয়স প্রায় চল্লিশ।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত ভোরে কলোনিতে এলে দেখা যাবে অফিসমুখী মানুষের রুদ্ধশ্বাস প্রস্তুতি, কেউ ছুটছেন বাজার নিয়ে কেউবা গোসল করতে লাইন ধরেছেন! রান্না ঘরে খালাদের চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে ঘুম চোখে অনেকেই বেরিয়ে আসেন কৌতূহলে! পরক্ষণে রোজকারের মতো আবার ঘরে ঢুকে যান বিড়বিড় করতে করতে। ৮টা থেকে সাড়ে ৮ টার মধ্যে কলোনি ফাঁকা হয়ে যায় অনেকটা! আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায় বিকেল পাঁচটার পর, ক্লান্তশ্রান্ত মানুষেরা অফিস থেকে ফিরতে শুরু করেন। সন্ধ্যায় তাদের ছোটছোট দল ইতিউতি জটলা করে খোশগল্পে মেতে ওঠে। আড্ডা চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। এরপর ঘরে ফেরা, ঘুমনোর প্রস্তুতি; আরেকটি ব্যস্ত সকালের অনিচ্ছাকৃত অপেক্ষা। হয়তো আজকের ক্লান্তিটা তখনো কাটবে না, তবুও সে ব্যস্ত দৃশ্য দেখা যাবে সরদার কলোনিতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ

Advertisement

কেএসকে/এএসএম