‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তালগাছ’ কবিতার বাস্তবদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলায়। এ উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়ক যা বর্তমানে তালতলী নামে পরিচিত পেয়েছে। সড়কের দু’পাশজুড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দেখা মিলবে অসংখ্য তালগাছ। সারি সারি এসব গাছের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে।
Advertisement
একটা সময় গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন সড়কের পাশে দেখা মিলতো তালগাছ। তবে সে দৃশ্য এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তালগাছের সংখ্যা কমে গেছে। তবে জেলা শহর থেকে পশ্চিমে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়ক। এ সড়কের দুইপাশে প্রায় পাঁচ হাজার তালগাছ আছে। তালগাছগুলো এ সড়কটিকে সৌন্দর্যময় করে তুলেছে।
ক্লান্তপথিক এ সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের ছায়ায় এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করে। সড়কের দুই পাশে দেখা মিলবে সবুজের ফসলের ক্ষেত। এটি একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে অন্যদিকে এ জায়গাটি পর্যটকদের কাছে এখন বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। নির্মল বাতাস আর তালগাছের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই দূর-দুরান্ত থেকে আসছেন বিনোদনপ্রেমীরা।
নিয়ামতপুর উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল মেঠোপথ। ১৯৮৬ সালে এ রাস্তার দুইপাশে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তালবীজ রোপণ করেছিলেন তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান ও বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। সেই বীজ থেকে এখন গজিয়েছে অসংখ্য তালগাছ।
Advertisement
রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো এখন শোভাবর্ধন করছে। এলাকাটি এখন পর্যটকদের কাছে ঐতিহ্যবাহী ঘুঘুডাঙা তালতলি হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন। জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিয়ত এই তালগাছ সড়কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন পর্যটকরা। গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে সড়কটি পাকাকরণ করা হয়।
পর্যটকদের বসার জন্য রয়েছে বেঞ্চ। এছাড়া পানির জন্য নলকূপসহ টয়লেটের ব্যবস্থাও রয়েছে। বিশেষ করে ছুটির দিন, ঈদ ও উৎসবের দিনগুলোতে পর্যটকদের বেশি আনাগোনা বাড়ে।
স্থানীয়দের উদ্যোগে গত দুই বছর থেকে সেখানে তিন দিনব্যাপী তাল পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। আর মেলাকে ঘিরে আশপাশের গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের আগমন ঘটে।
তালগাছের এ নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে হলে সড়কপথে নওগাঁ কিংবা রাজশাহী শহরে যেতে হবে। এরপর সড়কপথে বাস বা অটোরিকশাযোগে নিয়ামতপুর উপজেলা সদরে যেতে হবে। অথবা অটোরিকশাযোগে সরাসরি ঘুঘুডাঙা তালতলি সড়কে যাওয়া যাবে।
Advertisement
জেলার মান্দা উপজেলার পরানপুর গ্রাম থেকে স্বপরিবারে বেড়াতে আসা শিক্ষক রেজাউল করিম। তিনি বলেন, গ্রামে এখন তালগাছ তেমন দেখা যায় না বললেই চলে। এখানে একসাথে অসংখ্য তালগাছ এবং নির্মল পরিবেশ দেখে সত্যি মুগ্ধ। যে কেউ এখানে বেড়াতে আসলে মন ভালো হয়ে যাবে। এই তালগাছ শুধু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নয়, এখন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
রাজশাহী শহরের আম চত্বর থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে আসা ইউসুফ হোসেন বলেন, ফেসবুক ও ইন্টারনেটে এ জায়গাটির কথা শুনেছি। তবে কখনো আসা হয়নি। সময় করে পরিবার নিয়ে ছুটে আসা। অনেক সুন্দর পরিবেশ। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ করে শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইডস করা গেলে এ জায়গার গুরুত্ব আরও বাড়বে।
ঘুঘুডাঙা গ্রামের বয়জ্যেষ্ঠ ফারুক হোসেন বলেন, এক সময়ের মেঠোপথ এখন পাকাকরণ হয়েছে। গত কয়েক বছর থেকে এ সড়কটি তালতলি হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ প্রতিদিনই দেখতে আসছে। তালতলিতে অস্থায়ীভাবে কয়েকটি দোকান হওয়ায় বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব খাবারের দোকানে বেচাকেনা চলে।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজমুদার বলেন, হাজিনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১৯৮৬ সালে ঘুঘুডাঙ্গা এ রাস্তায় প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তালবীজ রোপণ করেছিলাম। সেই গাছগুলো এখন বড় হয়ে তাল দিচ্ছে। এক সময় প্রতিটি পুকুরের ধারে তালগাছ ছিল। ধুপধাপ করে পাকা তাল পড়তো। তাল কুড়ানো একটা উৎসব ছিল। মাটির বাড়ি তৈরি হওয়ায় সেসব গাছ কাটা পড়েছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, তাল গাছের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে রোপণ করা হয়েছিল। সে সময় ২৫ পয়সা দাম দিয়ে তালবীজ কিনে এ রাস্তার পাশে রোপণ করা হয়েছিল। যারা তালবীজ লাগায় তাদের কপালে তাল জোটে না। কিন্তু আমি তালবীজ লাগিয়ে তা থেকে তাল খাচ্ছি। এমনকি আমার সন্তান ও নাতি-নাতনিরাও খাচ্ছে।
এরই মধ্যে পর্যটকদের কাছে তালতলি পরিচিত পেয়েছে। পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে যা প্রয়োজন করা হবে বলে জানান খাদ্যমন্ত্রী।
এমআরএম/জেআইএম