জাতীয়

রাস্তা দখল করে বাজার, বছরে চাঁদা আদায় ৬০ লাখ টাকা!

রাজধানীর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত চেকপোস্ট পার হলেই কমে যাবে যানবাহনের গতি। চার লেনের সড়কটি সন্ধ্যা হতে না হতেই প্রায় দখলে চলে যায় ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের। আর রজনীগন্ধা মার্কেটের কাছে এলে তীব্র যানজট ঠেলে চলাচল করাই দায়। সারি সারি ভ্যানের ওপর অস্থায়ী এসব দোকান দেখে মনে হবে প্রধান বাজার যেন এখানেই। রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে বসেন আরেক শ্রেণির দোকানি। এসব দোকানের নিরাপত্তা দিতে প্রতিদিন পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে থাকে বলে অভিযোগ। দোকানিদের দেওয়া তথ্যমতে, তাদের দেওয়া চাঁদা অনুযায়ী বছরে প্রায় ৬০ লাখ টাকা তোলা হয় এখান থেকে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।

Advertisement

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন রাস্তা দখল করে বসছে এসব ভ্রাম্যমাণ বাজার। অবৈধ এসব ভ্যানের নিরাপত্তা দিতে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের গাড়ি। নির্বিঘ্নে যান চলাচলের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও পুলিশই এখানে প্রধান বাধা। সিটি করপোরেশন আর স্থানীয় কমিশনারের পাশাপাশি চাঁদাবাজির বড় অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেই।

মূল সড়কে ফলের দোকান বসিয়ে আহসান নামে এক ব্যক্তি তিন বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে এখানে একদিনও ব্যবসা করতে পারবো না। আর পুলিশ না চাইলে এখানে একটি দোকানও থাকতে পারবে না।

কত টাকা চাঁদা দেন, জানতে চাইলে এ দোকানি বলেন, সন্ধ্যার পর দোকান বসাই। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। এ সময়ের জন্য প্রতিদিন দুইশ টাকা দিতাম। এখন দিতে হয় সাড়ে তিনশ টাকা করে। সবারই বাড়ানো হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে চাঁদার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল, ময়লা পরিষ্কার আর পুলিশের চাঁদা মিলে সাড়ে তিনশ টাকা দেই। তবে বড় অংশ পায় পুলিশ। চাঁদা দিতে হয় আক্তারের কাছে। আক্তার এখানকার লাইনম্যান।

Advertisement

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন পাঁচশ টাকা চাঁদা দিতে হয় আমাকে। দোকান দেওয়ার সময় একবারে দিয়েছি ১০ হাজার টাকা। সব চাঁদাই যায় আক্তারের হাত দিয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাফরুল থানাধীন বিভিন্ন সড়ক দখল করে প্রায় ছয়শ অবৈধ দোকান বসে প্রতিদিন। যার অধিকাংশই বসে মিরপুর-১৪ থেকে হাই-টেক মোড় পর্যন্ত। এসব দোকানের কারণে নিয়মিত যানজট সৃষ্টি হলেও সংশ্লিষ্ট মহল নির্বিকার।

দোকানের আকার আর জায়গা বুঝে প্রতি দোকান থেকে দিনে দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়। গড়ে প্রতি দোকান থেকে নেওয়া হয় তিনশ টাকা। সে হিসাবে বছরে প্রায় ৬০ লাখ টাকা নেওয়া হয়।

এসব অবৈধ দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায়ে লাইনম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন আক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তি, যিনি পুলিশের হয়ে সব পরিচালনা করছেন। লিমন আর মানিক নামে আরও দুজন আছেন, তারা চাঁদা আদায়ে আক্তারকে সহযোগিতা করেন।

Advertisement

একাধিক দোকানি বলেন, আমরা কয়েক বছর ধরে এখানে ব্যবসা করে আসছি। কে, কোন জায়গায় দোকান দেবে আর কত টাকা চাঁদা দিতে হবে নির্ধারণ করে দেন আক্তার। হিসাবে গরমিল হলেই পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। ফাঁড়ি বা থানায় বসেই ফের দরকষাকষি করে মুক্তি পাওয়া যায়।

তবে আক্তার তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না। কারা, কীভাবে দোকান বসায় আমার জানা নেই। পুলিশের সঙ্গেও আমার এ নিয়ে কোনো যোগাযোগ নেই।’

অন্যদিকে লাইনম্যান মানিক বলেন, এখানকার চাঁদার হিসাব সব আক্তারের কাছে। আমি নিজেই সপ্তাহে এক হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে দোকান বসাই। আগে চাঁদা আদায় করলেও তাবলিগ থেকে ফিরে এসে এসব বাদ দিয়েছি।

স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার মতি মোল্লা বলেন, সড়কটি দখলমুক্ত করতে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। কোন শক্তির ওপর ভর করে এখানে দোকান বসানো হয়, আমার জানা নেই।

এদিকে, চাঁদা ও সড়ক দখল নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে বিরাজমান। অভিযোগ উঠলেও দায় নিতে নারাজ উভয়পক্ষই।

মিরপুর-১৪ ট্রাফিকে দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর আক্তার হোসেন বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই সড়ক দখলমুক্ত করছি। কিন্তু আবারও বসছে। আর অলিগলিতে এসব দোকান তো ট্রাফিক পুলিশ সরাতে পারে না। থানা পুলিশ ব্যবস্থা নিলেই সড়ক দখলমুক্ত হবে।

অন্যদিকে ইব্রাহিমপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ মেহেদি হাসান দায় দেন ট্রাফিক পুলিশের। তিনি বলেন, সড়কের দায়িত্ব ট্রাফিকের। সড়কে যা ঘটে তা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে।

এ বিষয়ে কাফরুল থানার ওসি (অপারেশন) আব্দুল বাতেনও পুলিশের চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত এখানে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক দোকানিকে ধরে এনে চালান করে দিচ্ছি। কিন্তু ফের বসছে। সিটি করপোরেশন ব্যবস্থা নিলে এমন হওয়ার কথা নয়।

মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কাফরুল থানার ওসির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ টাকা নিয়ে দোকান বসানোর অভিযোগ মিথ্যা। আমরা অনেক সময় তাদের ধরে আনলে তারা থানায় তদবির করে। দোকানদারদের মধ্যে কেউ কেউ ক্যান্টনমেন্টের বোর্ডের পারমিশন নিয়ে দোকান বসানোর কথা জানায়। তাদের ধরাও যায় না।

ওসি বলেন, দোকানিরা মাসে মাসে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে ভাড়া দেয়। তাদের সেখান থেকে ওঠানোও যায় না।

টিটি/আরএডি/এএসএ/এএসএম