আপনার মুঠো ফোনে অপরিচিত কেউ ফোন দিয়ে যদি আপনাকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা আছেন বলে জানায়, আপনি কী ভাববেন? অথবা আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টটিতে অপরিচিত কেউ হঠাৎ করে আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উপকার করতে চায়! নিশ্চয়ই আপনি অবাক হবেন? কেউ কেউ হয়তো আগ্রহী হয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এভাবেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আপনার বিস্তারিত তথ্য গ্রহণ করে বড় ক্ষতি করতে পারে সাইবার জগতের একটি চক্র।
Advertisement
এশিয়ার ক্ষেত্রে এই চক্র পরিচালনায় সবচেয়ে দুর্ধর্ষভাবে যারা জড়িত, তারা হলো চীনের ‘সাইবার গ্যাং’। নিউ ইয়র্কের দ্য ইপোচ টাইমসে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেছেন বিখ্যাত গবেষক অ্যান্ডার্স কর। কম্বোডিয়ার পুলিৎজার জয়ী সংবাদ সংস্থা ভিওডিকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কীভাবে সাধারণ মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়ে চীনারা প্রতারণা করে চলেছে। সেই সঙ্গে মধ্যযুগীয় ক্রীতদাস প্রথাও ফিরে এসেছে চীনের এই অপরাধ জগতে।
কম্বোডিয়ায় প্রায় ১ লাখ বিদেশি সাইবার অপরাধী কাজ করেছে যাদের বাছাইয়ের চেষ্টা চলছে বলে জানান দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি অফ স্টেট সোক ফাল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কম্বোডিয়ান সরকার প্রতারণার এই জাল ধ্বংস করায় তেমন একটা সাফল্য পায়নি। ফলে চীনা প্রতারণা বাণিজ্যের রমরমা কারবার এখনও বন্ধ হয়নি। বরং বাড়ছে।
চলতি সপ্তাহেই একটি প্রতিবেদনে, লস এঞ্জেলস টাইমস দাবি করেছে ‘কম্বোডিয়ার সরকার চীনা অপরাধ সিন্ডিকেটকে হাজার হাজার বিদেশি পুরুষ ও নারীকে অবাধে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ও তাদের নিজস্ব তথ্য অনুসারে অবৈধ কাজ করার জন্য প্রতারনাচক্রগুলো বহু মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে’।
Advertisement
ইপোচ টাইমস জানায়, চাইনিজ, ভিয়েতনামী, মালয়েশিয়ান, তাইওয়ানিজ, ইন্দোনেশিয়ান, বার্মিজ এবং থাই নাগরিকদের প্রতারকদের ঘাঁটিতে বন্দি করে রাখা হয়। হাজার হাজার মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করে সাইবার মাফিয়ারা নিজেদের এলাকায় বন্দি করে রাখে। বন্দিদের কাছ থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে কড়া নজরদারির মধ্যে সশস্ত্র পাহারায় রাখা হয়। শ্রমিকদের ঋণের ফাঁদেও ফেলা হয়। ক্রীতদাসে পরিণত শ্রমিকদের ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ধার্য করা হয় মুক্তির শর্ত।
ক্রীতদাস হিসেবে বন্দিদের এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকলেও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে বাংলাদেশিদের বন্দি করে মুক্তিপণ আদায়ের তথ্য ইতোপূর্বে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পর বর্তমানে চীনের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি এই আফ্রিকা। অবশ্য কম্বোডিয়ায় যেই দাসত্ব ব্যবস্থা তৈরি করেছে চীনের অপরাধীরা তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনসহ বিভিন্ন জায়গায় হোটেল বা ক্যাসিনোয় খাটানো হয় ক্রীতদাসদের। জুয়া, যৌন এবং পর্নোগ্রাফি প্রভৃতি কাজেও ব্যবহার করা হয় বন্দিদের। প্রতারকদের কথা না শুনলেই থাকে কঠোর শাস্তি। বর্বরোচিত অত্যাচারের পাশাপাশি তাদের অন্যত্র বিক্রিও করে দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের তাদের ফটোসহ মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে হাজার হাজার ডলারে বিক্রি করা হয়। সেই ছবিতেই উঠে এসেছে নৃশংসতার প্রমাণ। একজন শ্রমিককে দেখা যায় নিজের আঙুল হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায়। তেমনি একটি চক্র অন্য একজনকে ভূগর্ভস্থ ব্লাড ব্যাংকে পাঠিয়ে তার রক্ত এতবার নিয়েছে যে, শিরা খুঁজে পেতে তার উরু কেটে ফেলতে হয়েছিল।
Advertisement
গণমাধ্যমে কম্বোডিয়ার এসব দৃশ্য প্রকাশ পেতে থাকলে ভিডিওগুলো চলে আসে জনসমক্ষে। তারই জেরে বন্দিদের মুক্তির দাবিতে কূটনৈতিক চাপও বাড়তে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কম্বোডিয়ার কর্মকর্তারা গত সেপ্টেম্বরে অভিযান চালাতে বাধ্য হন। সেই অভিযানে হাজার হাজার ক্রীতদাসকে মুক্ত করা হয়েছিল।
কিন্তু আরও বহু বন্দি এখনও রয়ে গেছেন। চীন এবং কম্বোডিয়ার সরকার এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতেই ব্যস্ত। প্রতারণা আড়াল করতে বন্দিদের মিয়ানমার এবং লাওসসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
টাইমস পত্রিকার বরাত দিয়ে ইপোচ টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে চীনের সাইবার মাফিয়া সিন্ডিকেটের বোঝাপড়া রয়েছে। তাই কম্বোডিয়ার স্থানীয় দুর্নীতি এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।
ভিওডির বরাত দিয়ে লিন নামে এক চীনা ক্রীতদাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। তবে লিন তার আসল নাম নয়। তার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই নামটি বদলে দিয়েছে ভিওডি। চীনা পুলিশ এবং কম্বোডিয়ায় চীনের দূতাবাসে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন লিন। তার অভিযোগ, কম্বোডিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চীনা সংস্থা তাকে একটি হোটেলে ক্রীতদাস করে রেখেছে। কিন্তু চীনা দূতাবাস তাকে কোনো সাহায্য করতে অস্বীকার করে।
লিনকে বন্দি করে তার ফোন কেড়ে নেওয়ার পর তাকে যৌন কাজে বাধ্য করা হয়। তার মাধ্যমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মতো জায়গায় ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের টার্গেট করে তাদের থেকে হাজার হাজার ডলার আয় করার চেষ্টা করে প্রতারকরা।
আটক ব্যক্তি তার অপহরণকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য কেলেঙ্কারিতে অংশ নেওয়ার পরই ফোন ফেরত পেয়েছিল। ফোন ফেরত পাওয়ার পর বাথরুম থেকে প্রশাসন এবং অন্যান্য অলাভজনক উদ্ধারকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পান তিনি। অপরাধ চক্রটি অনিচ্ছুকদের বড় বড় ব্যবসায়িক কম্পাউন্ডের মধ্যে আটকে রাখে। বাইরে থেকে যেগুলোকে কোনো হোটেল গ্রুপ বা প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে মনে হয়।
পত্রিকাটির বর্ণনা অনুযায়ী, চাইনিজ, কম্বোডিয়ান এবং ভিয়েতনামী উদ্ধারকারীরা বন্দিদের মুক্ত করতে সাহায্য করেছিল। মুক্ত ক্রীতদাসদের মধ্যে একজনের ভিওডি নাম রাখে ঝাং। ঝাংয়ের বরাত দিয়ে দ্য ইপোচ টাইমসে লেখা হয়েছে, কম্বোডিয়ার সামরিক পুলিশ সিহানুকভিল ‘ক্রাউন’ কম্পাউন্ড থেকে তাকে বের করে আনে।
চীনা এবং থাই ক্রীতদাসদের উদ্ধার করার আরেকটি অভিযান পরিচালনার সব তথ্য কম্বোডিয়ান পুলিশ থাই পুলিশের কাছে গোপন রেখেছিল। থাই পুলিশ থাইদের জন্য ৭১টি ওয়ারেন্ট জারি করেছে। এর মধ্যে শুধু ২১টির প্রত্যাবাসন হয়েছে। যাদের থাই পুলিশ গ্রেফতারের চেষ্টা করেছিল সেইসব চীনা প্রতারককে কম্বোডিয়া এখনও মুক্তি দেয়নি।
অনুরূপ চীনা গ্যাং ফিলিপাইন অফশোর গেমিং অপারেটরের (পোগো) সঙ্গেও যুক্ত। সেখানেও চীনা, মালয়েশিয়ান এবং বার্মিজ ক্রীতদাসদের দেখা মেলে। কম্বোডিয়ার মতোই ফিলিপাইনে সাইবার ক্রীতদাস কেনাবেচা হয়।
চীনা প্রতারকরা নিজেদের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিমদের বেইজিং আধুনিক দাসত্বে প্রসারিত করছে। অ্যান্ডার্স করের মতে, যদি আমরা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিসিপি) তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে দেই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠবে। কারণ চীনের অন্যান্য কর্মসূচির মতো অপরাধীদের রফতানি করেও গোটা দুনিয়াকেই বিষিয়ে তুলছে তার এক কৌশল হিসেবে। নিজেদের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতেই ক্রীতদাসদের মাধ্যমে ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তারেও সক্রিয় বেজিং।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম