রাজধানীর মোহাম্মদপুরে থাকেন ব্যাংকার দম্পতি তারিক ও আবিদা। বেতন পান মোটামুটি বড় অংকের। থাকেন ভাড়া বাসায়। রাজধানীতে নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকবেন- এ আশা দীর্ঘদিনের। উদ্যোগও নিয়েছেন কয়েকবার, যোগাযোগ করেছেন আবাসন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে। হিসাব মেলেনি। সম্প্রতি চার বা সাড়ে চার হাজার টাকা স্কয়ার ফুটের জায়গার দাম চাওয়া হচ্ছে ছয়-সাত হাজার টাকা। বাড়তি দামের কারণে ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত থেকেই আপাতত সরে এসেছেন তারা।
Advertisement
তারিক বলেন, দুই বছর আগেও ফ্ল্যাটের দাম কিছুটা কম ছিল। করোনা পরবর্তীসময়ে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে অনেক। এখন ফ্ল্যাট কিনতে হলে বাড়তি ঋণ নিতে হবে, গুনতে হবে সুদ। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আর কেনা হচ্ছে না ফ্ল্যাট।
একই কথা জানান বাসাবোর বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে কিছু টাকা ছিল, কিছু টাকায় চীন থেকে ইলেকট্রিক পণ্য আমদানি করতাম। এখন এলসি না থাকায় ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। ভাবছিলাম পুঁজিবাজারের টাকা উঠিয়ে ফ্ল্যাট কিনবো। কিন্তু দাম তুলনামূলক বেশি। তাই গ্রামে কিছু জমি কিনেছি সে টাকায়। যেসব আবাসন কোম্পানির কাছে গিয়েছি তারা বাড়তি দাম বলছে। আসলে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা থমকে আছে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উচ্চমূল্যে রড, সিমেন্ট, টাইলস বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে এসব উপকরণের কাঁচামালের দাম। এতে আবাসন প্রকল্পেও ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি খরচ পড়ছে। একই সঙ্গে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ইট, বালু। এসব কারণে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি নেই। ২০২১ সালের চেয়ে চলতি বছর অর্ধেকে নেমেছে বিক্রি।
Advertisement
বর্তমানে বাজারে এখন প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ৯২ হাজার ৩শ টাকায়। এর আগে কখনো রডের দাম এত বেশি হয়নি। এক-দু’মাস আগেও এসব রড ছিল ৮৫-৮৬ হাজার টাকা। বাজারে বর্তমানে ৫শ টাকার নিচে কোনো সিমেন্ট নেই। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৩০ টাকায়। এর আগে গত মার্চে সিমেন্টের দাম ৫২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তবে একমাস আগে এসব সিমেন্ট ছিল ৪০০-৪২০ টাকা। আর টাইলসের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরের ব্যবধানে রডে প্রতি টনে প্রায় ৬০ শতাংশ দাম বেড়েছে, সিমেন্ট প্রতি ব্যাগে ২২ শতাংশ বেড়েছে। কারণ রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকারের পুরোটাই আমদানি করতে হয়। তাছাড়া পাথর প্রতি ঘনফুটে ২৪ শতাংশ, ইট প্রতি হাজারে ২২ শতাংশ, মোটা বালু প্রতি ঘনফুটে ৫০ শতাংশ, ইলেক্ট্রিক ক্যাবলে (১.৫ বিওয়াইএ) দাম বেড়েছে ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত।
চলমান বা শেষ হয়েছে এমন অনেক আবাসন প্রকল্পে বাড়তি দাম চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। নির্মাণসামগ্রীর দামের অজুহাতে এ বর্ধিত দাম চাওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবে অভিযোগও আসে একাধিক। পরে রিহ্যাব পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কাজ শুরুর পর অতিরিক্ত খরচ (রড-সিমেন্ট ইত্যাদির দর বৃদ্ধির প্রভাব) ১০ শতাংশের কম হলে আগের দামেই ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে ক্রেতার কাছে। আর ১০ শতাংশের বেশি খরচ পড়লে ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতার ভিত্তিতে তার দাম নির্ধারণ হবে।
রিহ্যাব সহ-সভাপতি সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবসা করেন। ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হোক এটা ব্যবসায়ীরা চান না। ক্রেতার চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখেই কাজ করছেন ব্যবসায়ীরা। যাদের অভিযোগ ছিল সেগুলোর যৌক্তিকভাবে সমাধান করা হচ্ছে।
Advertisement
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সূত্র জানায়, প্রতি বছর দেশে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গড়ে বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজার করে ফ্ল্যাট। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বিক্রি হয় গড়ে ১২ হাজার ৫শ ফ্ল্যাট। ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৪ হাজার এবং ২০২১ সালে বিক্রি হয় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট। তবে গত বছরের (২০২১) তুলনায় চলতি (২০২২) বছরের নভেম্বর এখন পর্যন্ত অর্ধেকও বিক্রি হয়নি। নভেম্বর পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে মাত্র ৮ হাজারের মতো। ব্যবসায়ীদের আশা ছিল ২০২২ সালেও ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হবে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দামও কিছুটা বেড়েছে। আর এতেই বিক্রিতে ধস নেমেছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ বলেন, করোনাকালীন সব কিছু থমকে যায়। তখন থেকেই মূলত দাম বাড়তে থাকে নির্মাণসামগ্রীর। কারণ তখন আমদানি হচ্ছিল না। পরবর্তীসময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চলমান প্রকল্পে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লে একটা যৌক্তিক সমাধান দেওয়া হয়েছে। আমরা একটি বাসযোগ্য নগরী গড়তে কাজ করে যাচ্ছি। যদি কোনো প্রকল্পে ১০ শতাংশ বা তার বেশি দ্রব্যমূল্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে তা ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান হবে। এখানে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক আমরা চাই না।
সম্প্রতি টাইলসের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ছোট টাইলসের দাম। ছোট টাইলসের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের ওপর। আর বড় টাইলসের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিরামিকের যেসব পণ্য আছে তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই টাইলস। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশের মতো স্যানিটারিওয়্যার। ১০ শতাংশ ডিনার সেট, টি সেট, মগ, বাটির মতো ক্রোকারিজ সামগ্রীর পণ্য। দেশে টাইলস উৎপাদনে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে বড় বাজারের ৯০ শতাংশ রয়েছে ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানির দখলে।
তাজিম টাইলসের ম্যানেজার মো. রুবেল জাগো নিউজকে বলেন, ছয় মাস ধরে টাইলস বিক্রির অবস্থা খুবই খারাপ। মাস ছয়েক আগেও প্রতিদিন তিন থেকে চার লাখ টাকার মাল (টাইলস) বিক্রি হতো, এখন দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিক্রি হচ্ছে। এমনিতেই বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়েছে। জীবনধারণ করাই এখন মানুষের জন্য বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দালান এখন তুলনামূলক কম হচ্ছে। আবার জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে টাইলসের দাম বেড়েছে। আগে যে টাইলস ৩২ টাকা প্রতি স্কয়ার ফুট বিক্রি করেছি, এখন তার দাম ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। সব কিছু মিলেই বিক্রি কম।
ইএআর/এএসএ/এমএস