রাজনীতি

খালেদার গৃহ গোছাচ্ছে আওয়ামী লীগ

লক্ষ্মীপুর-২ খালেদা জিয়ার আসন হিসেবে খ্যাত। রায়পুর উপজেলা ও সদরের ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে দুবার নির্বাচন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। আসনটিতে স্বাধীনতার পর উপ-নির্বাচন ছাড়া কখনো জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও একবার বিপুল ভোটে বিএনপি জিতেছে, আর গেলো দুবার আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেয় জাতীয় পার্টিকে।

Advertisement

আসনটি নিয়ে নানান নাটকীয়তার পর ২০২১ সালের উপ-নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি হন। শহীদুল ইসলাম পাপুল নৈতিক স্খলনজনিত কারণে এমপি পদ খোয়ানোর পর তিনি লড়েন উপ-নির্বাচনে। ভোটের মাঠে বরাবরই পিছিয়ে থাকা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন তিনি। এরই মধ্যে রায়পুর উপজেলা ও পৌর সম্মেলন করে কমিটি দিয়েছেন। দুই আসনের ১৯টি ইউনিয়নেও সংগঠন সক্রিয়। তিনি বেশ ভালোভাবেই ঘর গোচাচ্ছেন।২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জোটগত কারণে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ নোমানকে ছেড়ে দেয়। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে নাটকীয়ভাবে নোমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী শহীদুল ইসলাম পাপুল (আপেল প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও পাপুলের জন্য নির্বাচনী মাঠে ছিলেন।

জানা যায়, উপ-নির্বাচনে এমপি হওয়া নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নকেই আবারও মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। এছাড়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ, জেলা কমিটির সহ-সভাপতি এহসানুল কবির জগলুল, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-পরিবেশ সম্পাদক শামসুল ইসলাম পাটোয়ারী আছেন আলোচনায়। বিএনপি থেকে জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও পৌরসভার সাবেক মেয়র সাহাব উদ্দিন সাবু, খালেদা জিয়ার সাবেক নিরাপত্তা সমন্বয়কারী আবদুল মজিদ মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। জাতীয় পার্টি থেকে সাবেক এমপি ও জাপার প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা মোহাম্মদ নোমান, নোয়াখালী জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন মিঠু মাঠে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

জেলা জামায়াতের আমির এম রুহুল আমিন ভুইয়াকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে ফেসবুক প্রচারণা চালাচ্ছে তারা।

Advertisement

এলাকা ঘুরে জানা যায়, এলাকাটিতে বিএনপির সমর্থক ও কর্মীর আধিক্য আছে। তবে টানা ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ কিছুটা প্রভাব তৈরি করেছে। বিশেষ করে বর্তমান এমপি এলাকায় সময় দেন, কাজ করেন।

স্থানীয় একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, নয়ন ভাই (এমপি) সংগঠন গুছিয়ে ফেলছেন। নেতাকর্মীরা তাকে পান। প্রশাসনের ওপরও অবৈধ হস্তক্ষেপ করেন না, সুসম্পর্ক রেখেই চলেন। পাশাপাশি এখানে জগলু সাহেবও (ডা. এহসানুল কবির জগলুল) ক্লিন ইমেজের লোক।

তিনি বলেন, এটা আগে থেকেই বিএনপির আসন। তাদের অবস্থান ভালো। তবে বিএনপির প্রার্থী আবুল খায়ের ভূঁইয়া অসুস্থ, এলাকায় কম আসেন।

৬ নম্বর কোরোয়া ইউনিয়নের লামচরি গ্রামের আরিফ হোসেন বলেন, এমপি সাহেবকে আমি এলাকায় তেমন একটা দেখি না। কারণ আমার ব্যবসা আছে, ব্যস্ত থাকি। রাজনীতি যারা করে তারা হয়তো এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে। তবে লক্ষ্মীপুর তো বিএনপি অধ্যুষিত।

Advertisement

আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি

রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ জুটন বলেন, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে হারানোর ক্ষমতা নেই বিএনপির। ক্ষমতায় থাকায় আমাদের মধ্যে কিছুটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের মোকাবিলায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাই।

‘রাজনীতিতে ওয়ার্ড লেভেলে জং ধরে গেছে, নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন।’ বলেন এই নেতা।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান এমপি আসেন। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন। তাকে আমরা সব সময় পাশে পাই। তার বাইরে এখানে আমি প্রার্থী দেখি না। কেউ থাকলেও হালে পানি পাবে না। কারণ সুসময়ের মধু খেতে এলে তো হবে না।

উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শরিফ হোসেন খোকন বলেন, সরকারের সুযোগ-সুবিধা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে হয়। তারা ভোটসহ নানা কারণে বিলি-বণ্টনে নিজের ইচ্ছামাফিক করেন। সঠিকভাবে দিলে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী পাবে, তারা দলের প্রতি আকৃষ্ট হবে।

তিনি বলেন, এ অঞ্চলটি বিএনপির। কিন্তু গত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় অনেক উন্নয়ন করেছে, সরকার নানান সহযোগিতা করে। এগুলোর কিছুটাও যদি আওয়ামী লীগ প্রচার করতো তাহলে সরকারের ইমেজ আরও ভালো হতো। আমি প্রচার সম্পাদক নামে, প্রচার-প্রচারণায় বাজেট নেই দলে। অথচ বিরোধী শিবিরে এগুলোতে ব্যাপক বাজেট আছে। তারা সরকারবিরোধী প্রোপাগাণ্ডায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে।

‘বাজার মনিটরিং করলে আমাদের ভোটের মাঠে মানুষকে জবাব দিতে সহজ হবে। সরকারি সেবায় দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এগুলোর কারণেই সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’ মনে করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক।

রায়পুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন নোমান বলেন, সেবার কাজে ঘুস নেওয়ার চেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি আরও ভালো। রায়পুরে আমরা এগুলো করি না। ২৭শ ভোট, কাস্টিং ভোটের ৬০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগ পাবে। বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক থাকলে পুরো আসনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জিতবে।

নির্ভার বিএনপি আত্মবিশ্বাসী

বিএনপি নেতারা বলছেন, এটি খালেদা জিয়ার আসন। তিনি এখানে নির্বাচন করেছেন। তার প্রতি জনগণের একটা সহানুভূতি আছে। তার পক্ষে বা তার প্রার্থী হিসেবে এখানে যে দাঁড়াবেন সেই পাস করবেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও সাবেক পৌর মেয়র সাহাব উদ্দিন সাবু বলেন, আমাদের আগে হলো আন্দোলন। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবি নিয়ে সক্রিয়। তারপর যাকে নেত্রী দেবেন, তিনিই জিতবেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ মো. শামছুল আলম বলেন, লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশেই তৃণমূল সংগঠন সুসংগঠিত। বিভাজন আছে প্রার্থীদের মধ্যে। লক্ষ্মীপুরে চারটি আসন, এর মধ্যে জোট থাকবে কি না বা নির্বাচনের কৌশল কী হবে, তার ওপর নির্ভর করবে প্রার্থিতা।

১৯৯১ থেকে ২০০৮

চার নির্বাচনে এই আসনটিতে বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে খোদ খালেদা জিয়া এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ‘৯৬-এ খালেদা জিয়া ছেড়ে দেওয়ার পর উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আর ২০০১ এ বিএনপি জয় পেয়েছে। ২০১৪ সালে সংসদে আওয়ামী লীগের বিরোধীদল খ্যাত জাপার প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ জাপাকে দিলে পরে কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুলকে সমর্থন দেয়, যিনি নৈতিক স্খলনজনিত কারণে এমপি পদ হারিয়েছেন।

ভোটের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৮ সালে বিএনপির আবুল খায়ের ভূঁইয়া পান ৫৭ শতাংশ ভোট (প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৯৫), আওয়ামী লীগের হারুনুর রশিদ পান ৩৯ শতাংশ ভোট (প্রাপ্ত ভোট ৫১ হাজার ৭৩২)।

২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী খালেদা জিয়া পান ৭২ শতাংশ ভোট (প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ২৩ হাজার ৫২৬), আওয়ামী লীগের হারুনুর রশিদ পান ২৬ শতাংশ (প্রাপ্ত ভোট ৪৪ হাজার ৯৭৪)।

১৯৯৬ সালে বিএনপির প্রার্থী খালেদা জিয়া ভোট পান ৫১ শতাংশ (প্রাপ্ত ভোট ৫৯ হাজার ৫৪), আওয়ামী লীগের তোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী পান ২৩ শতাংশ (প্রাপ্ত ভোট ২৬ হাজার ৯৩৭)।

১৯৯১ সালে আসনটিতে বিএনপির প্রার্থী মোহাম্মদুল্লাহ ভোট পান ৫৩ শতাংশ (প্রাপ্ত ভোট ৩৮ হাজার ৫৯৯) জামায়াতের এম এ জব্বার ৩৩ শতাংশ (প্রাপ্ত ভোট ৩০ হাজার ৯৭)।

সংগঠন গোছাচ্ছে আওয়ামী লীগ

বিএনপির দুর্গের দখল নিতে এরই মধ্যে বেশ সক্রিয় আওয়ামী লীগ। ২০২১ সালের উপ-নির্বাচনে আসা এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন সংগঠন গোছাচ্ছেন। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। এতে কাজী জামশেদ কবির বাক্কি বিল্লাহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি ও গোপন ভোটে আবু সাইদ জুটন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

আবু সাইদ জুটন বলেন, সম্মেলনের মাধ্যমে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডেই আমাদের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা সংগঠনকে আরও গুছিয়ে নিচ্ছি। এর মাধ্যমেই আমরা বিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করবো। ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে।

৩১ মে রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। এতে মামুনুর রশিদকে সভাপতি ও রফিকুল হায়দার বাবুল পাঠানকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়।

রফিকুল হায়দার বাবুল পাঠান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ৭টি ইউনিয়নে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। বামনী ও উত্তর চরবংশী আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। এছাড়া উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই মারা গেছেন। এই তিনটি ইউনিয়নে সম্মেলন করে দলকে আরও সুসংগঠিত করা হবে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চররুহিতা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কবির হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ১১ মে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আমরা নির্বাচিত হয়েছি। লক্ষ্মীপুর-২ সংসদীয় আসনের ৯টি ইউনিয়ন সদর উপজেলার মধ্যে পড়েছে। সবগুলো ইউনিয়নেই দলের সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ, সেখানে আগামী দুই মাসের মধ্যেই সম্মেলন শেষ করা হবে। দলীয় সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ওয়ার্ড পর্যায়ে আমরা সরকারের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের শাখা কমিটিগুলো করার জন্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

এসইউজে/এএসএ/এমএস