বিনোদন

যেভাবে দর্শকনন্দিত অভিনেত্রী হলেন সুবর্ণা মুস্তাফা

সুখন সরকার

Advertisement

সৌন্দর্যময়ী চেহারা, মুগ্ধতা ছড়ানো হাসি, মায়াবী চোখ, অমায়িক ব্যবহার তার। সেই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত কথা, সুচারু অভিনয় দক্ষতা-সব মিলিয়ে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্রবোধের প্রায়োগিক প্রকাশে নিজেকে অনন্য যোগ্যতায় এ দেশের মানুষের হৃদয়ে শিকড় থেকে শিখরে আসন গড়ে নিয়েছেন। তিনি হলেন নন্দিত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা।

তিনি একাধারে বেতার, টেলিভিশন, মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, নির্মাতা, প্রযোজক এবং মাননীয় সংসদ সদস্য। আবৃত্তি, উপস্থাপনা, ধারাভাষ্য, মঞ্চের নেপথ্যকর্মসহ সমাজ-সংস্কৃতির নানাবিধ ক্ষেত্রে সংযুক্ত হয়ে রেখেছেন সাফল্যের অভিজ্ঞান।

রুচিশীল, নান্দনিক, সজ্জন, মানবিক মানুষ সুবর্ণা মুস্তাফার আজ শুভ জন্মদিন। তার জন্য সমগ্র আকাশের মতো অসীম উদার শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও ভালোবাসা। বাংলাদেশের বিজয় বছরে না হলেও, প্রিয় অভিনেত্রীর জন্মদিন বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে হওয়ায় অনুভুতিতে গর্বের মাত্রাও যুক্ত হয় বৈকি।

Advertisement

১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন আজকের জননন্দিত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। তার বাবা প্রখ্যাত অভিনেতা, আবৃত্তিকার গোলাম মুস্তাফা ও মা তৎকালীন বেতার প্রযোজক হোসনে আরা বিজু, বোন ক্যামেলিয়া।

পৈত্রিক সূত্রে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া গ্রামে বাড়ি হলেও সুবর্ণা মুস্তাফার জন্মোত্তর বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ফলে তার শৈশব, কিশোরীকালও ঢাকায় কেটেছে। মায়ের সঙ্গে রেডিওতে যাওয়ার সুবাদে মাত্র ৫-৬ বছর বয়সে যুক্ত হয়ে পড়েন রেডিও নাটকে। কাজ করেন অনেক বেতার নাটকে। এমনকি নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি।

জহির রায়হানের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘বরফ গলা নদী’ দিয়ে তার টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের শুরু হয়। টেলিভিশনে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত কাজ করতেন। তারপর ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর (এম. এ.) সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেন।

একসময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পক্ষে সরব হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি সরাসরি সান্নিধ্য পেয়েছেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, প্রয়াত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ, স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বিভাগীয় শিক্ষকবৃন্দের।

Advertisement

সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও তাকে সস্নেহে সান্নিধ্য দিয়েছেন। তার শিক্ষকদের সংস্পর্শে তিনি সরাসরি অনেক ভালো কিছু কাজ গ্রহণ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। ১৯৭৫ সালে আব্দুল্লাহ-আল মামুনের প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সুভা’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বিটিভিতে নিয়মিত হন সুবর্ণা মুস্তাফা। ঐ বছরেই তিনি ঢাকা থিয়েটারে ভর্তি হন।

৭০-এর দশকে সেলিম আল দীন রচিত, আল মনসুর নির্দেশিত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চাভিনয়ে যাত্রা শুরু করেন। তারপর একই সঙ্গে মঞ্চ ও টিভি নাটকে সমানতালে অভিনয় করে এগিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির পরিচালনার ‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৮১ সালে ‘লাল সবুজের পালা’ চলচ্চিত্রে নীলা চরিত্রে অবতীর্ণ হতে দেখা যায় তাকে।

১৯৮৩ সালে কাজী জহির পরিচালিত ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক সিনেমায় যুক্ত হন। এই চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। তারপর ‘সুরুজ মিয়া’ (১৯৮৪) সিনেমাতে নোলকি চরিত্রে, ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’সিনেমায় জাতীয় পুরস্কার অর্জনসহ ‘শঙ্খনীল কারাগার’সিনেমায় ১৯৯২ সালে রুনু, ‘কমান্ডার’১৯৯৪ সালে, ‘পালাবি কোথায়’ ১৯৯৭ সালে, ‘গহীন বালুচর’১৯১৭ সালে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি ‘একা একা’, ‘রাক্ষস’, ‘ফাঁসি’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অন্যদিকে ‘প্রাইভেট ডিটেক্টিভ’, ‘দূরত্ব’, ‘খণ্ড গল্প ৭১’, ‘হেড মাস্টার’, ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’ স্বল্প দৈর্ঘ সিনেমাতে অভিনয় করেন তিনি। সর্বশেষ ‘গণ্ডি’, ‘লীলাবতী’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সুবর্ণা।

মামুনুর রশীদ পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘শিল্পী’ নাটকে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো ধারাবাহিকে যুক্ত হন সুবর্ণা মুস্তাফা। ১৯৯০ সালে বরকত উল্লাহ নির্মিত টেলিভিশনের ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এ মুনা চরিত্রে, ১৯৯১ সালে ‘অয়োময়’এবং ১৯৯৯ সালে ‘আজ রবিবার’ নাটকে মীরা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকনন্দিত হন। তার অভিনীত বিটিভিতে সর্বশেষ ধারাবাহিক নাটক বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’।

এর বাইরে বেশ কিছু ধারাবাহিক ও অসংখ্য একক টেলিভিশন নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়াও ‘ ফেরিওয়ালা’, ‘এক আকাশ মেঘের গল্প’, ‘চিলেকোঠা ও ভাড়াটিয়া’, ‘সুরভী’ ‘ ভোরের ট্রেন’সহ অনেক টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি। তার নিজের নির্মিত টিভি নাটক ‘আকাশ কুসুম’(২০০৯)। নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার।সুবর্ণা মুস্তাফা দীর্ঘ ২৫ বছর ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চনাট্যে কাজ করেছেন।

নির্দেশক নাসিরুদ্দিন ইউসুফ সযত্নে তাকে গড়েছিলেন ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ ‘শকুন্তলা’, ‘কসাই’, ‘কিত্তন্খোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘যৈবতি কন্যার মন’সহ বেশ কিছু মঞ্চনাট্যে। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালে কানাডায় টরেন্টোর মঞ্চে আবারও অভিনয়ে দেখা যায় সুবর্ণা মুস্তাফাকে। স্বামী বদরুল আনা সৌদ রচিত ও নির্দেশিত ‘একটি কাল্পনিক সত্যি কাহিনি’ মঞ্চপ্রযোজনায় অভিনয় করেন তিনি।

এসবের পাশাপাশি ২০১৫ সাল থেকে রেডিও ‘ভূমি’তে ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার হিসেবে অবতীর্ণ সুবর্ণা মুস্তাফা। বিটিভি, চ্যানেল আই’সহ বেশ কিছু টেলিভিশনে ও মঞ্চে উপস্থাপনা করেছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বাছাইয়ে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

মাস্তুল ফাউন্ডেশন সন্মান স্মারক, গোলাম মুস্তাফা স্মৃতি সন্মানসহ অনেক স্মারক, সন্মাননা, পুরস্কার, জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। ২০১৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করে। একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দলীয় সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪ (৩০৪), ঢাকা-২২ থেকে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন।

লেখক: শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এমএমএফ/জিকেএস