>> চিড়িয়াখানায় পর্যটক ঢোকে না>> প্রাচীন সভ্যতা দেখতে আগ্রহ কম>> ঐতিহাসিক স্থাপনায় নেই নিরাপত্তা
Advertisement
উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চিড়িয়াখানা রংপুরে। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার আর পশুর চিকিৎসার নামে চরম দায়িত্বহীনতাসহ নানা অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এ চিড়িয়াখানা। ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন পর্যটক। তবে রংপুরের মতো বেহাল অবস্থা উত্তরের একাধিক ভ্রমণ স্পটের। সুযোগ সুবিধা ও রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে এসব স্থান ভ্রমণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পর্যটকরা।
দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গের জনজীবন, ভূপ্রকৃতি, নদী, লোকসংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর নিজস্ব গড়ন দৃশ্যমান রয়েছে হাজার বছরের ধারাবাহিকতায়। তবে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই সভ্যতার জৌলুস ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
রংপুর চিড়িয়াখানায় বাঘ ছিল না। ছিল একটি বৃদ্ধ বাঘিনী। সেটাও মারা গেছে। একটি মাত্র সিংহ রয়েছে, যার আয়ুষ্কাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। জলহস্তি তিনটির মধ্যে একটি মারা গেছে। অনেক প্রাণীর সঙ্গী নেই। ফলে প্রজনন হচ্ছে না চিড়িয়াখানায় থাকা পশুর। চিড়িয়াখানার অনেক খাঁচা প্রাণীশূন্য, ফলে এক সময়ের বহুল আলোচিত এ চিড়িয়াখানার জৌলুস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দর্শকের কোলাহলে এক সময় মুখর থাকা চিড়িয়াখানাটিতে এখন আর দর্শক যায় না বললেই চলে।
Advertisement
দর্শনার্থী এবং কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এখানকার পরিবেশ বাঘ প্রজননের উপযোগী হওয়ায় নব্বই দশকে প্রতিষ্ঠিত এ চিড়িখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার সব মিলিয়ে ২২টিরও বেশি বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল। এখান থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানায় বেশ কয়েকবার নিয়েও যাওয়া হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে রংপুর চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার কুয়েতের আমিরকে শুভেচ্ছা নিদর্শন হিসেবে উপহার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখভালের অভাবে সেই চিড়িয়াখানার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। বেশ কয়েকটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। এখন বাঘশূন্য অবস্থায় এ চিড়িয়াখানা। সঙ্গী মারা যাওয়ায় একটি সিংহ একাকী জীবন-যাপন করছে। বর্তমানে যে সিংহী আছে তার বয়স ১৮ বছর পার হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, সর্বোচ্চ ১৬-১৮ বছরের বেশি বাঁচে না সিংহী। ফলে যে কোনো সময় এটি মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
রংপুর নগরীর হনুমানতলা এলাকায় ২২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রংপুর চিড়িয়াখানা। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, ভাল্লুক, জলহস্তি, ডোরাকাটা হায়না, ওয়াটার বাক, হরিণসহ বেশ কিছু বিরল প্রজাতির প্রাণী ছিল। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার গত ১৭ বছরে ২২টি বাচ্চা এবং সিংহ দম্পতি ছয়টি বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এসব প্রাণীর বসবাসযোগ্য কোনো ঘর তৈরি করা হয়নি। ছোট্ট খাঁচায় কোনো রকমে রাখা হয় প্রাণীগুলো।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মজিদ বলেন, বখাটেদের উৎপাত, চিড়িয়াখানায় প্রাণীর বেহাল দশাসহ নানা কারণে দর্শনার্থী সংখ্যা একেবারেই কম। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাসহ নানা কারণে ইতোমধ্যে সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অনেক দুর্লভ প্রাণী মারা গেছে।
পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসা আফরোজা বেগম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এখানে কোনো পরিবেশ নেই। চিড়িয়াখানার আকর্ষণ বাঘের খাঁচায় বাঘ নেই। একমাত্র সিংহের জীবন প্রদীপও নিভু নিভু। পশু-পাখির খাঁচাগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
Advertisement
নগরীর আলমনগর এলাকার বাসিন্দা ফরিদ আলী জানান প্রাণীদের পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয় বলে মনে হয় না, যা তাদের স্বাস্থ্য দেখলেই বোঝা যায়। চিড়িয়াখানায় সার্বক্ষণিক পশুচিকিৎসক নেই।
রংপুর চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর আম্বার আলী তালুকদার জানান, বাঘটি সঙ্গীর অভাবে মারা গেছে। সিংহটিও একা সময় কাটাচ্ছে। তবে অচিরেই দুটি বাঘ, দুটি সিংহ ও দুটো জেব্রা আসছে। চিড়িয়াখানার যাবতীয় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গের সভ্যতার দিকে তাকালে দেখা যায়, মৌর্য ও গুপ্ত রাজাদের শাসনামলে মহাস্থানগড় হয়ে উঠেছিল ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে। উত্তরবঙ্গের পুন্ড্রনগর ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখনো সেখানে রাজা-রানির স্মৃতিচিহ্ন আছে, তবে আগের সেই জৌলুস নেই। পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো এই দর্শনীয় স্থানটিও পড়ে রয়েছে অবহেলায়।
মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বহু রাজার রাজ্য। এছাড়া মাজার শরিফ, কাঁটাবিহীন বড়ই গাছ, পশুরামের প্রাসাদ ও প্রাচীর, গোবিন্দভিটা, মহাস্থানগড় জাদুঘর, বেহুলার বাসরঘর, শিলা দেবীর ঘাট, ভাসুবিহার, বাংলাদেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রে সজ্জিত রয়েছে। প্রয়োজন শুধু পর্যটকদের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা।
নওগাঁয় কুসুম্বা মসজিদ, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, পালরাজাদের স্মৃতিচিহ্ন, বলিহার রাজবাড়ি, জবাই বিল, জগদ্দল বিহার এখনো জেগে আছে ইতিহাসের স্মারক চিহৃ রূপে। তবে সুযোগ সুবিধার অভাবে সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম। সেই সঙ্গে পতিসরে রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি পর্যটনের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান হলেও সেখানে থাকার ব্যবস্থা না থাকায় দিনে দিনে ঘুরে আসতে হয়।
যমুনা সেতু সিরাজগঞ্জ জেলাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন মাত্রায়। বেলকুচির তাঁতীদের তাঁতপল্লি ও তাঁতশিল্প, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, দরগাহ মসজিদ, শিবমন্দির ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে পর্যটনের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন হলেও কর্তৃপক্ষের নজর নেই। পর্যটন লিস্টেও এসব স্থানের নাম দেখা যায় না।
জয়পুরহাট বহুদিন গৌড়ের পাল ও সেন রাজাদের রাজ্যভুক্ত ছিল। রাঙ্গাদিঘি, নান্দাইল দিঘি, লাকমা রাজবাড়ী, পাথরঘাটা দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শনার্থী যেতে চায়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়া সেখানে দিন দিন পর্যটক কমছে।
হাওর-বাঁওড় ও বিল দিয়ে সাজানো পাবনা জেলা। দেশের সবচেয়ে বড় চলনবিলের একটা অংশ এই জেলাকে ঘিরে। বর্ষায় ভরা বিলে নৌকা নিয়ে মাছ ধরা ও টাটকা মাছ দিয়ে খাবার খাওয়া এক নতুন অনুভূতির জোগান দেয়। এ ছাড়া পাকশি, ঈশ্বরদীর চিনি মিল দেখার সুযোগ থাকে। তবে ভ্রমণ পিপাসুরা বলছেন, নৌকা নিয়ে চলনবিলের মধ্যে গেলে নিরাপত্তাহিনতায় ভুগতে হয়। বাইরের পর্যটকদের প্রায়ই স্থানীয় বখাটেদের হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়।
রাজা গোবিন্দের ষাট হাজার গরুর গোচরণভূমির নামে গাইবান্ধা জেলার নামকরণ করা হয়েছে। গাইবান্ধা জেলায় পর্যটকদের মনকাড়ার মতো অনেক জায়গা রয়েছে। তার মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের কুটিবাড়ী, পলাশবাড়ী এডুকেশন পার্ক, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, মাটির নিচে সবুজ ঘর ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, কাস্টকালীর মন্দির, বালাসিঘাট, যমুনার চরসমূহ। কিন্তু যে কোনো স্থান থেকে গাইবান্ধার এসব স্পটে যেতে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়া চাই, যা এখন নেই।
রংপুর জেলার ভিন্নজগৎ, বেগম রোকেয়ার বাড়ি, নীলদরিয়া বিল, তাজহাট জমিদার বাড়ি, চিকলী বিল বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে বেশ পরিচিত। এ অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের জীবনমুখর ব্যাপ্তি আর লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্যের স্বাদ পর্যটন শিল্পের উপকরণে পরিণত করেছে। কিন্তু সঠিক উদ্যোগের অভাবে এসব স্থানে পর্যটক নেই বললেই চলে।
দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির, রামসাগর দিঘির সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের বিমোহিত করে। এছাড়া এই জনপদের ভূপ্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির চলমান ধারা পর্যটন শিল্পে নান্দনিক সংযোজন ঘটাতে পারে, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। কিন্তু সেখানে পর্যটকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে পর্যটকরা খুব একটা যায় না।
নীলফামারী জেলাকে নীলের দেশ বলা হয়। একসময় ব্রিটিশরা এখানকার চাষিদের বাধ্য করতো নীল চাষে। এই জেলার প্রতিটি স্থান এক একটি ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাস জানার পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুরা দেখতে পান নীলসাগর, ময়নামতি দুর্গ, সিন্ধুরমতি দিঘি ও মীরজুমলার মসজিদ। তবে ভ্রমণ তালিকায় এসব স্থানের নাম তোলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বরাবরাই উদাসীন।
মহারাজা বিশ্বসিংহের কুড়িটি পরিবারের দেশ থেকেই কুড়িগ্রাম জেলা। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোই এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া শাহী মসজিদ, বীর প্রতীকপ্রাপ্ত তারামন বিবির বাড়ি, নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি, চিলমারী বন্দর পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
একই ভাবে দেশের সবচেয়ে বেশি ছিটমহল ছিল লালমনিরহাটে, যা আজ বিলুপ্ত। ছিটমহলগুলোর বৈশিষ্ট্য আলাদা দেখে মনে হবে দেশের মধ্যে আরেকটি ছোট্ট বাংলাদেশ। এই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা যোগ করতে পারবেন পর্যটকর। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য পর্যকটদের কোনো নির্দেশনা বোর্ড, থাকার ব্যবস্থা বা পুলিশি নিরাপত্তা নেই।
পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড় জেলা। যেমন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর তেমনি অসাধারণ অতিথিপরায়ণ মানুষের বসতি। চা-বাগান ও পাথরে সমৃদ্ধ। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের অধিকারী এই জেলার মানুষ। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ এখানকার অর্থনীতিকে করেছে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হিমালয়ের কন্যা পঞ্চগড় যেন হিমালয়ের কৃপার দান। বাংলাবান্ধা পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠছে অন্য রকম আবেদনের জায়গা।
উত্তরবঙ্গের পর্যটনের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রয়োজন শুধু প্রচার-প্রসার ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তরবঙ্গ পর্যটন স্থাপনা ও স্থানগুলোকে প্রচার-প্রসারে কাজ করলে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের নতুন একটি দিগন্তের উন্মোচন হবে। বাড়বে অথনৈতিক সমৃদ্ধি।
প্রাচীন স্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, পর্যটক আকৃষ্ট করতে আমরা প্রাচীন নিদর্শনগুলো উন্মুক্তের পাশাপাশি সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। বিশেষ করে খনন করে যেসব স্থাপনা বের হচ্ছে এখন সেগুলো ঢেকে না দিয়ে উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে।
এএইচ/জেআইএম