স্বাস্থ্য

বছর বছর বাড়ছে এইডস রোগী

মরণব্যাধি এইডস। এই রোগ নিয়ে সমাজে রয়েছে ব্যাপক ভীতি। রয়েছে অজ্ঞতা, কুসংস্কার আর ঘৃণা। এর ফলে এইচআইভি বহনকারী ব্যক্তিকে যেমন শারীরিক অসুস্থতা পোহাতে হয় তেমনি সামাজিকভাবেও পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। এদিকে বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিচারে এখনো বেশি না হলেও এইডস রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে এই রোগ নিয়ে সমাজে ঝুঁকিও বাড়ছে।

Advertisement

জাতিসংঘের এইচআইভি-এইডস বিষয়ক সংস্থা ইউনিএইডস বলছে, দেশে ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে এইডস কমানোর প্রচেষ্টায় ছেদ পড়ে। ২০১৬ সালে ৫৭৮ জন এবং ২০১৭ সালে ৮৬৫ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়। ২০১৮ সালে তা আরও বেড়ে ৮৬৯ এবং ২০১৯ সালে হয় ৯১৯ জন। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে দেশে করোনা মহামারি প্রতিরোধে লকডাউন শুরু হয়। বছরজুড়ে চলা বিধিনিষেধের মধ্যে সে বছর নতুন শনাক্ত কমে হয় ৬৫৮ জন। তবে ২০২১ সালে করোনা সংক্রমণ কমার ফলে ফের বাড়ে এইডস শনাক্ত কার্যক্রম। এর ফলে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যাও বাড়ে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৭২৯ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ (বৃহস্পতিবার) ১ ডিসেম্বর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য, ইকোলাইজ অর্থাৎ ‘অসমতা দূর করি এইডস মুক্ত দেশ গড়ি।’ এ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে রোগী শনাক্তকরণ পরীক্ষায় সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

Advertisement

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়া বেলা সাড়ে ১১টায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে ওসমানী মিলনায়তনে। সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী চলতি বছরের এইডস পরিস্থিতি তুলে ধরবেন।

পাশাপাশি, আইসিডিডিআর,বি; ব্রাক, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বেসরকারি সংস্থাগুলো হাতে নিয়েছে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি।

দেশে এইডস রোগীদের চিকিৎসায় একমাত্র প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এখানে রোগীরা ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শ্রীবাস পাল জাগো নিউজকে বলেন, এ হাসপাতালে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরের ৯২৫ জনের এইডস পরীক্ষা করা হয়। এতে ১০৫ জন পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন। তবে তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৭২৫ জনকে পরীক্ষা করে ৬৩ জন পজিটিভ শনাক্ত হয়েছিলেন। তারও আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত করোনা মহামারির মধ্যে ৬৪২ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করে মাত্র ৪৩ জন রোগী শনাক্ত হয়।

Advertisement

গত একবছরে রোগী বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে দেশে অন্যান্য রোগের মতো এইডস চিকিৎসাতেও কিছুটা ছেদ পড়ে। ফলে রোগী শনাক্ত কম হয়। তবে মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সারাদেশে এইডস কর্মসূচিতে সন্দেহভাজন রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেড়েছে। ফলে শনাক্ত চিকিৎসা নেওয়ার হারও বেড়েছে।

হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান জানান, ২০১৬ সাল থেকে তাদের হাসপাতালে এআরটি সেন্টারের (ভাইরাসটি আক্রান্তদের চিকিৎসায় অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল ওষুধ ব্যবহার) মাধ্যমে এইচআইভির বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এআরটি সেন্টার চালুর পর নিবন্ধন করা হয়েছে মোট ৮০৯ জন রোগীর। তাদের মধ্যে ১১৭ জনকে অন্য সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে এআরটি নিবন্ধিত এ পর্যন্ত ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে গত একবছরে মারা গেছেন ১৯ জন।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, স্বয়ং ডাব্লিওএইচও’র তথ্য বলছে, করোনাকালে বিশ্বব্যাপী এইচআইভি বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এসে নতুন রোগী কমে গেছে। মূলত করোনার সময় বিধিনিষেধ থাকায় এইচআইভি নিয়ে রিপোর্টিং ঠিক মতো হয়নি। এতে শনাক্ত কম দেখাচ্ছে।

জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে রোগটি প্রথম ধরা পড়ে। ধারণা করা হয়, দেশে ১৪ হাজারের বেশি এইডস আক্রান্ত রোগী রয়েছেন।

২০২১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (হিজড়া, যৌনকর্মী, সমকামী ও শিরায় মাদক সেবনকারী) ৬৫ হাজার ৬৮৯ জনের পরীক্ষা করা হয়। সবমিলে ওই বছর ৬ লাখ ২৮ হাজার ৩১২ জনের পরীক্ষা এবং ৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ জনের স্ক্রীনিং করা হয়। এসময় ৭২৯ জন এইচআইভি পজিটিভ ও ২০৫ জনের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে ২০২০ সালে মোট ৫ লাখ ২ হাজার ১৬৫ জনকে পরীক্ষা এবং ৮ লাখ ৩০ হাজার ৪২৪ জনের স্ক্রীনিং করে ৬৫৮ জনের এইডস শনাক্ত হয়। তাদের মধ্য ১৪১ জন মারা যান।

তবে জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন পর্যন্ত ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমণের হার শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশের নিচে। যা স্বস্তির বিষয়। অন্যদিকে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমারে এই রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। তবে এই মহূর্তে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংক্রমণ হার কমানো।

তারা বলেন, করোনার সময়ে রোগী শনাক্তে পরীক্ষা কিছুটা কম হলেও তেমন প্রভাব পড়েনি। সেসময় রোগীদের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এখন পরীক্ষা কেন্দ্র বাড়িয়ে ২৮টি করা হয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্র সাতটি থেকে করা হয়েছে ১১টি। এখন ব্যাপক প্রচার করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে অনুমিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৯৫ শতাংশ শনাক্ত করতে হবে। এজন্য প্রথমে সারাদেশ থেকে রোগী খুঁজে বের করতে হবে। ৬৪ জেলায় স্ক্রিনিং সেন্টার স্থাপনের কাজ চলছে।

এএএম/এমএইচআর/এএসএম