মতামত

নিজস্ব মুদ্রা ও ডলারের ঔপনিবেশত্য

বইমেলা আসছে। বেড়ে গেছে কাগজের দাম। লেখক-প্রকাশক বন্ধুদের সাথে কথা হলেই টের পাই, বই ছাপানোর খরচ বেড়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে সবাইকে। এমনিতেই বইবিমুখ বাঙালি বই কিনতে চায় না। দাম বেড়ে গেলে বই না কেনার মোক্ষম অজুহাত পাওয়া যাবে। নোরা ফাতেহি’র অনুষ্ঠানের টিকিটের দাম নাকি ছিল ১৫ হাজার টাকা। এই দাম বেশি দাম বলে গণ্য হয় না অনেকের কাছে। তবে বইয়ের দাম সবার কাছেই চড়া। আগেও ছিল। এখন আরও চড়ল, এই আর কি!

Advertisement

কাগজের দাম বাড়লো কেন? ডলারের দাম বেড়ে গেছে। সোজা উত্তর। ডলার ছাড়া কাগজ কেনার উপায় নেই কেন? ডলার ছাড়া কাগজ পাওয়া যায়, এমন কোনো উৎস কি নেই? কয়েক দিন আগে ছোট্ট দেশ নেপাল দারুণ একটি প্রস্তাব দিয়েছিল রাশিয়াকে। নিজস্ব মুদ্রায় নেপাল রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করতে চায়। রাশিয়ার রুবল আর নেপালের রুপির বিনিময়ে একটি প্রক্রিয়া তৈরি করা যায় বলে রাশিয়ায় নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত বলছিলেন।

নেপাল রাশিয়া থেকে সার এবং প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম কিনতে চায়। বিনিময়ে রাশিয়া নেপাল থেকে চা এবং চামড়াজাত পণ্য কিনবে বলে ভাবছে। কি পরিমাণ সার নেপালকে দেওয়ার বিনিময়ে কি পরিমাণ চা রাশিয়ায় যাবে, তা ঠিক করতে পারলেই কিন্তু হলো। এভাবে নিজস্ব মুদ্রার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশগুলোর মাঝে বিনিময় বাণিজ্য শুরু হওয়া এখন সত্যিই দরকার। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যাংকিং সহযোগিতা এমনভাবে হবে, যাতে ডলার বা এরকম কোনো দাপুটে ঔপনিবেশিক মুদ্রার কথা ভাবতে না হয়।

প্রাচীনকালে মানুষ যখন মুদ্রার ব্যবহার জানতো না, তখন নাকি এভাবেই বাণিজ্য করতো। একজনের গাছের লাউ নিত আরেকজন, বিনিময়ে দিত নিজের পোষা গাভির দুধ। কড়ি, মূল্যবান পাথর, মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার শুরু হলো এরপর। কাগজে ছাপার কৌশল শিখে ফেলার পর কাগজের মুদ্রার দাপট শুরু হলো। ঔপনিবেশবাদী তত্ত্ব শেখাল, শাসকের ছবিওয়ালা কাগজের মুদ্রার ব্যবহার যত পার ছড়িয়ে দাও। যত বেশি ব্যবহার, তত বেশি আধিপত্য। যত বেশি আধিপত্য, তত বেশি স্থিতিশীলতা। মুদ্রার বিনিময় হারের চালাকিতে আধিপত্য টিকিয়ে রাখার খেলা দারুণ মজার। ডলারের দামের ওঠানামা অন্য সব মুদ্রার চেয়ে অনেক কম বলে এর ওপর ভরসা রাখার সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে।

Advertisement

এখন কোভিড-১৯ অতিমারির ধাক্কা সামলে না ওঠা বিশ্বের পিঠে দুড়ুম করে কিল বসানো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ডলারের দামকে পাগল ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে ছেড়েছে বলে বাজারে হায় ডলার হায় ডলার মাতম। ডলার কমলে রিজার্ভ কমে। রিজার্ভ কি জিনিস, এ নিয়ে এখন আমরা যত জ্ঞান আহরণ করেছি, তা এর আগে কোনো দিন করেছিলাম কি না মনে পড়ে না। ডলার নেই তো খাবার নেই। ডলার নেই তো তেল নেই, গ্যাস নেই। ডলার নেই তো কাগজও নেই।

এভাবে আর কতদিন? তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে ডলারের ঔপনিবেশত্য আর কত মানতে হবে? ইলেক্ট্রনিক ট্রেডিং প্লাটফর্ম, স্বয়ংক্রিয় লেনদেন ব্যবস্থায় অন্য মুদ্রার তারল্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। বহু দেশ নিজস্ব মুদ্রায় রিজার্ভ সামলানো শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে, বিশ্বের ৫৫টি উদীয়মান বাজার অর্থনীতির ৩০টি দেশের রিজার্ভ নাকি ন্যূনতম দরকারি মাত্রার চেয়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বেশি। রিজার্ভে অতিরিক্ত মুদ্রা অলস ফেলে না রেখে একে দেশের বিনিয়োগে কাজে লাগানো যায়।

পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের কৌশলকে এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। ডলার নয়, টাকায়ই রিজার্ভ ব্যবহার করে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এই টাকা রিজার্ভ থেকে ধার হিসেবে নেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট মুনাফাসহ রিজার্ভেই আবার ফিরে যাবে টাকাটা। ডলার বাবাজি টেরও পেল না। টের যে পেল না, এতে ডলারের তথাকথিত সম্মানে টানাপোড়েন তো হলোই, ডলারের চাহিদাও কমে গেলো।

ডলারের আগে এত দামে কিনতে হয়নি। এ অবস্থা কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা ডলারের চাহিদা কমানোর উপায় খুঁজছে। এই উপায় না খুঁজে উপায় কি? ইউক্রেনকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে কম উৎসাহ দিয়েছে ডলার ঔপনিবেশবাদ? পরিকল্পনা ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে ডলারের হারানো গৌরব উঠিয়ে আনা হবে।

Advertisement

যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে জমাকৃত রাশিয়ার রুবলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়, যার পরিমাণ নাকি রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। রাশিয়া এতে সাইজ হবে ভাবলেও রাশিয়ার তুরুপের তাস যে তেল আর গ্যাস। রুবল দিয়ে তেল ও গ্যাস কেনার জন্য চাপ দিচ্ছে রাশিয়া।

অনেক দেশ এতে রাজিও হচ্ছে। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলোই তো রুবল দিয়ে গ্যাস কিনতে চাইছে। উপায় কি? শীতে জবুথবু ইউরোপে হিটিং সিস্টেমের রেশনিং শুরু হয়ে গেছে। গাদাগাদা গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে সুকান্তের কবিতা আওড়াতে হচ্ছে, হে সূর্য! শীতের সূর্য!

এ বছরের জুনে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চায়না ও সাউথ আফ্রিকার নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে গঠিত ‘ব্রিকস’ ফোরামে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘মুদ্রা ঝুড়ি’ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঝুড়িতে থাকবে ব্রিকস-এর সব দেশের মুদ্রার অংশগ্রহণ। বোঝাই যাচ্ছে, ঝুড়িটা ডলারমুক্ত। রাতারাতি এই ঝুড়ি ফল জোগাবে, তা না হলেও ডলারের আধিপত্য কমানোর প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে।

তুরস্ক, মিশর, সৌদি আরব ব্রিকস-এ যোগ দিতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু সৌদি আরব থেকে তেল নেবে চীন। চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মাধ্যমে তেলের দাম পরিশোধের বিষয়ে দুই দেশ আলোচনা করছে। সম্ভব হয়ে গেলে বৈশ্বিক পেট্রোলিয়াম বাজারে ডলারের আধিপত্য কমবে। গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে ইউয়ানের, তথা চীনের নিজস্ব মুদ্রার।

একই পদ্ধতি অন্য দেশগুলোও অনুসরণ করতে চাইবে। ‘ডি-ডলারাইজেশন’ শুরু হয়ে গেছে এশিয়ার ব্যাংকগুলোতে। মোবাইল ব্যাংকিং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শুরু হচ্ছে নতুন নিয়ম। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন এভাবেই মোবাইল অ্যাপের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবছে।

শিগগির চালু হবে নতুন এই পদ্ধতি। তখন থ্যাইল্যান্ডের কেউ ইন্দোনেশিয়ায় পণ্য রফতানি করতে চাইলে ইন্দোনেশীয় অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন করলে এর মূল্য সরাসরি ইন্দোনেশীয় রুপিয়াহ থেকে থাই বাথে বদলে যাবে। মধ্যস্বত্বভোগীর মতো ডলার আংকেলের খোঁজ কেউ নেবে না। নিতে হবে না।

কাগজের দাম বাড়ুক, এরকম ডলার-দুঃস্বপ্ন সত্যিই দেখতে চাই না। ইতোমধ্যে ডলার ছাড়াও অন্য দেশের মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা-ই বলছিলাম, টাকা দিয়ে কাগজ কিনতে চাই। এমন কোনো উপায় আসুক, যাতে আমরা যে দেশ থেকে কাগজ আমদানি করব, সে দেশে টাকাই পাঠাব। ওখানে সেই টাকা সেই দেশের মুদ্রায় বদলে যাক।

ডলারের আধিপত্যের জোরে ‘মার্কিনিরা নিজেদের অদ্বিতীয় মনে করে এবং যদি তারা মনে করে যে তারা অদ্বিতীয়, তার মানে অন্য সবাই দ্বিতীয় শ্রেণির’, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার দেশের ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে এভাবেই বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কিছুই চিরকাল স্থায়ী হয় না।’

আসলেই তা-ই। কড়ি হারিয়ে গেছে। সম্রাট শাহজাহানের ছবিওয়ালা সোনার মোহরও নেই। ডলারও হয়তো এক সময় হয়ে পড়বে মূল্যহীন। আগামী দুই দশকের মধ্যেই ডলারের আধিপত্য কমে আসবে, এই আশংকা করছেন খোদ মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরাই। তবে ডলারের জায়গায় আর কোন একক মুদ্রা নতুন আধিপত্য তৈরি করুক, এটা চাই না।

বিশ্ব কখনোই সমতার জায়গা গড়ে দিতে পারেনি, কেবলই আধিপত্যবাদের জয়গান গেয়েছে। সময় এসেছে, যার যা কিছু আছে তার মূল্যায়ন করার। ডলারের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে হবে না টাকাকে। টাকা যা দিতে পারবে, তা দিতে টাকাকে যেন কেউ জোর করে দাবায়ে রাখতে না পারে। একই কথা প্রযোজ্য সোমালিয়ান শিলিংয়ের জন্যও। ঔপনিবেশত্যবাদ নিপাত যাক!

লেখক: সাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম