দেশজুড়ে

সুন্দরবন ভ্রমণে ভোগান্তি বাঁকে বাঁকে

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সুন্দরবন ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের প্রথমেই নামতে হয় মোংলা বন্দরের পিকনিক কর্নারে। সেখানে পৌঁছানোর পরই বেকায়দায় পড়তে হয় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য। কারণ পিকনিক কর্নারে গাড়ি পার্কিংয়ের মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই।

Advertisement

জায়গার অভাবে রাস্তায় ও বাসস্ট্যান্ডে রাখতে হয় গাড়ি। রাস্তায় গাড়ি রাখলেও সেখানে ঘটে বিপত্তি। কারণ বন্দর কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ এ রাস্তা দিয়ে বন্দরের পাইলটসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করে থাকেন। আবার একই রাস্তায় বন্দর ব্যবহারকারীরা তাদের গাড়িও রাখেন। এজন্য বন্দরের নিরাপত্তা কর্মীরা এসে পর্যটনবাহী গাড়িগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। এজন্য পার্কিং সমস্যার কারণে কোনো গাড়ি পিকনিক কর্নারে আসতে চায় না।

শুধু তাই নয়, পিকনিক কর্নারে পর্যাপ্ত ওয়াশরুম ও বিশ্রামাগার নেই। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিশু, পুরুষ-নারীরা যে হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হবেন তারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। মাত্র চারটি শৌচাগার দিয়ে চলছে হাজার হাজার পর্যটকের প্রয়োজনীয়তার কাজ।

এরপর বনে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন হয় পর্যটক ও সংশ্লিষ্ট নৌযানের পাস পারমিটের। তবে সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যায় না বন বিভাগের অনুমোদন। এক্ষেত্রে আগেভাগেই অনুমোদন নিয়ে নিতে হয় আগতদের। আর কেউ যদি হঠাৎ করে এসেই পড়েন তাহলে তার আর ভোগান্তির শেষ নেই। তাদের দৌড়াতে হয় বাগেরহাট ও খুলনায়।

Advertisement

পাস কিংবা অনুমোদন পাওয়ার পর পিকনিক কর্নার থেকে নৌযানে ওঠার পালা। সেখান থেকেই আবারও নতুন করে ভোগান্তি শুরু। নৌযানে ওঠার মতো নেই জেটি ও পন্টুন। তাই অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। জোয়ার হলে বোট নদীর পাড়ে ভিড়িয়ে তোলা হয় যাত্রীদের।

যাত্রীদের বোটের ওঠার আগেই অবশ্য দামদর ঠিক করে নিতে হয়। আগে থেকেই ঠিক না করলে নৌযান মালিকেরা যে যার মতো করে গলাকাটা হারে ভাড়া নিয়ে থাকেন পর্যটকদের কাছ থেকে।

এরপর পর্যটন কেন্দ্রগুলোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেন পর্যটকরা। তবে এসব নৌযানে নেই বিপদে পড়লে জীবন রক্ষাকারী জিনিসপত্র যেমন লাইফবয়া, লাইফ জ্যাকেট। তাই সাগর ও নদী উত্তাল থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ করতে হয় সুন্দরবনে।

পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নৌযান ভেড়ানো ও পর্যটকদের ওঠানামার জন্যও সুব্যবস্থা নেই। নৌযান মাঝ নদীতে রেখে ছোট ছোট নৌকায় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয় পর্যটন কেন্দ্রের ঘাটে। তবে এখানকার ঘাটেও নেই দর্শনার্থীদের ওঠানার পর্যাপ্ত পুল, জেটি ও পন্টুন। তাই নৌযানে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটে আসছে হরহামেশা।

Advertisement

পথ ভুলে যাওয়া, বন্যপ্রাণীর আনাগোনা ও আক্রমণ থেকে সতর্ক থাকার জন্য প্রশিক্ষিত গাইডের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তারও ব্যবস্থা নেই। জনবল কম থাকায় আগত দর্শনার্থীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে বন বিভাগ। দু-একজন করে গানম্যান দিলেও বিনিময়ে তাদের দিতে হয় মোটা অংকের টাকা।

পর্যটকরা জানান, সামান্য পরিমাণ পায়ে হাঁটার পথ (ফুট টেইলার) ও যৎসামান্য উঁচু ওয়াচ টাওয়ার ছাড়া সুন্দরবন দেখার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। পর্যটকদের বনের গভীরে ঢোকার অনুমতি নেই বন বিভাগের। তাই পর্যটন কেন্দ্রের কোয়ার্টার ও হাফ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা গাছপালা, বন্যপ্রাণী দেখেই ফিরতে হয় দর্শনার্থীদের। বনের গহীনের খালের ভেতরে প্রবেশ ও বনের অভ্যন্তরে রাত্রিযাপনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হতাশ হন দর্শনার্থীরা।

পিকনিক কর্নারের দোকানি জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পর্যটকরা এখানে এলেই নানা দুর্ভোগের কথা বলেন। এখানে টয়লেট, হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা এমনকী ঘাট নেই। ট্রলারে উঠতে বসে থাকতে হয় জোয়ারের জন্য। এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। তা নাহলে সুন্দরবনে পর্যটকের দিনে দিনে কমে যাবে।’

পাবনা থেকে পর্যটক নিয়ে পিকনিক কর্নারে আসা মাইক্রোবাসচালক সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘মোংলায় এসে দেখি এখানে গাড়ি রাখার কোনো গ্যারেজ নেই। গাড়ি রাখতে সমস্যা হয়। গাড়ি কোথায় রাখবো তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকি।’

পর্যটন ব্যবসায়ী রাকিব হাওলাদার বলেন, ‘ঘাটে বাঁশের একটি সিঁড়ি দিয়ে রেখেছি। তা দিয়ে ওঠানামায়ও সমস্যা হচ্ছে। পন্টুন ও ভালো ঘাটের ব্যবস্থা নেই। করমজল পর্যটন কেন্দ্রের পন্টুনের অবস্থাও খুব খারাপ। লোকজনের ওঠানামায় কষ্ট হচ্ছে।’

আরেক পর্যটন ব্যবসায়ী রিপন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিকনিক কর্নারে আমাদের ঘাটটির অবস্থা খুবই খারাপ। জোয়ার না হলে আমরা পর্যটক ওঠাতে ও নামাতে পারি না।’

কথা হয় পিকনিক কর্নারের একজন ইজারাদারের প্রতিনিধি ইউসুফ সুমনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পিকনিক কর্নারটি মূলত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্যই ইজারা দেওয়া। কিন্তু এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। যেটুকু জায়গা আছে তার মধ্যে আবার বন্দরের ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পের ডকইয়ার্ড ও মালামাল রাখা হয়েছে। ফলে গাড়ি পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’

মোংলা জালি বোট মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি এইচ এম দুলাল জাগো নিউজকে বলেন, ৩০ বছর ধরে আমরা এখানে ট্যুরিজমের কাজ করে আসছি। এখানে যখন কোনো পর্যটক আসেন তখন তার শৌচাগার ও বিশ্রামাগার দরকার হয়। কিন্তু তার কিছুই নেই। নৌযানে ওঠার জন্য ঘাটের ব্যবস্থা নেই। পন্টুন ও জেটি খুবই দরকার।

এ বিষয়ে বন বিভাগের খুলনাঞ্চলের বনসংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, এখানে টয়লেট ও ঘাটের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে পিকনিক কর্নারের ওই জায়গা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের। এজন্য বেসরকারিভাবে ওখানে এসব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, তবে এগুলোর খুব প্রয়োজন। তবে সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় পন্টুন ও গ্যাংওয়ে রয়েছে।

বনের ভিতরে রাত্রিযাপনে কটেজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কটেজের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। কারণ যারা সুন্দরবনে যান তারা ঘুরে চলে আসেন। বনের ভেতরে রাতে থাকলে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ সুন্দরবনের সব জায়গায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, পানির উৎস নেই। কাজেই এ বিষয়গুলো আমরা করতে চাচ্ছি না।

এসআর/এএসএম