মতামত

তলাবিহীন ঝুড়ির কিসসা

তলাবিহীন ঝুড়ির ব্যবহারিক অর্থ কী তা বুঝতে বাংলাদেশের কোনো মানুষেরই অসুবিধা নাই। একটি ঝুড়িতে ফল, ফুল, ধান, চাল যাই রাখা হোক না কেন, তলা না থাকায় তা ঝুড়ির নিচ দিয়ে পড়ে যাবে। অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোনো ‘বরকত’ দেখা না গেলে সেটাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে মনে করা হয়।

Advertisement

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই দেশ সম্পর্কে এই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাগধারা হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়। এর উৎস বাংলাদেশে, কিন্তু বন্দুকটি রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অব স্টেট) হেনরি কিসিঞ্জারের ঘাড়ে। কিসিঞ্জার নাকি বাংলাদেশকে একটি bottomless basket বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

সেই সময়ে অপব্যাখ্যাটি কেউ বুঝে শুনে করেছেন, নাকি ইংরেজি ভাষা বোঝার ঘাটতি থেকে করেছেন তা এখন আর জানার উপায় নেই। তবে যারাই বুঝে বা না বুঝে করে থাকুক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই টার্মটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ৫০ বছর ধরে এবং এই টার্ম ব্যবহার করে ফায়দা লোটার চেষ্টা চলছে সর্বদা।

তলাবিহীন ঝুড়ির ইংরেজি bottomless basket, আক্ষরিক অর্থে। কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জার বা অন্য কেউ বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলেননি। এবং তলাবিহীন ঝুড়ি বলতে আমরা যে বাগধারাটি ব্যবহার করি, সেই অর্থ বোঝাতে কোনো আমেরিকানই bottomless basket ফ্রেজ ব্যবহার করে না। তারা বলে bottomless pit অথবা rat hole যার মর্মার্থ একই।

Advertisement

কিসিঞ্জারদের আলোচনায় কথাটি ছিল basket case। এই বাস্কেট কেস এবং বটমলেস বাস্কেট ইডিয়মস দুটির অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্কেট কেস বলতে আমেরিকানরা বোঝেন কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের অসহায় অবস্থা, যার জরুরি সাহায্যের প্রয়োজন। বাংলাদেশ সম্পর্কে এই বাস্কেট কেস ফ্রেজটি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ইউ. অ্যালেক্সিস জনসন। তারই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিসিঞ্জার পুনঃউচ্চারণ করেন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন কক্ষে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। বিষয় দক্ষিণ এশিয়া। সে মিটিংয়ে গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।

বাংলাদেশে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, Then we had better start thinking about what our policy will be. অর্থাৎ তাহলে আমাদের পলিসি কী হবে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। তার কথার উত্তরে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এর পাকিস্তান ও ইরান বিষয়ক পরিচালক (পরে ইউনাইটেড ন্যাশনস ফুড কাউন্সিলের পরিচালক) মরিস উইলিয়ামস বলেছিলেন, By March the Bangla Desh will need all kinds of help. অর্থাৎ মার্চ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সব ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সময় ইউ. অ্যালেক্সিস জনসন বলেন, Theyʼll be an international basket case. তারা হবে একটি আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিষয়বস্তু। তার উত্তরে কিসিঞ্জির বলেন, But not necessarily our basket case. এই মিটিংয়ের ট্রান্সক্রিপ্ট এখন এক মিনিটেই যে কেউ দেখতে পারেন ইন্টারনেটের সুবাদে।

এই ছিল ঘটনা। ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’র মতো শুরু হয়ে যায় তলাবিহীন ঝুড়ির গল্প। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের আলোচনা ভালো কি মন্দ ছিল সেটা বড় কথা নয়। একটি ভুল ব্যাখ্যা কেন একটি দেশের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা পাবে? (এমন অনেক ভুল আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা হয়ে আছে, যেগুলো নিয়ে অন্য নিবন্ধে আলোচনা করা যাবে) কেন সেই অপব্যাখ্যাকে রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করবেন?

যতটা জানি, এ নিয়ে একাধিকবার বাংলাদেশের সাংবাদিক বা রাজনীতিকরা কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ১৭টি গ্রন্থপ্রণেতা কিসিঞ্জার মনে করতে পারেননি যে তিনি বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলেছেন। তবে পরে সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন বিষয়টি কী হয়েছে এবং এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বিরক্ত হয়েছেন। হওয়ারই কথা।

Advertisement

এই তলাবিহীন ঝুড়ির গল্প বাংলাদেশে এখনো সব রাজনৈতিক পক্ষই ব্যবহার করে। আজও! আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা লিখতে গিয়ে, টক শোতে কৃতিত্ব নিতে গিয়ে উদ্ধৃত করেন, ‘হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি, দেখুন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নেই!’ আর বিএনপির তো কথাই নেই। যেন হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্র পেয়েছে।

গত ১৯ নভেম্বর সিলেটের আলিয়া মাদরাসা মাঠের সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশকে আবারো তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে আওয়ামী লীগ। লক্ষণীয় তিনি ‘আবারো’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

অর্থাৎ তার ভাষায় আগেও আওয়ামী লীগ তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়েছিল দেশকে। এবং বিএনপির বহু নেতা বিভিন্ন সময় এমনভাবে তলাবিহীন ঝুড়ি কথাটি ব্যবহার করে আসছেন যার মধ্যে একটি আবহ থাকে যেন বিদেশ থেকে টাকা এসেছে আর আওয়ামী লীগ সব খেয়ে ফেলেছে। এবং সেটা বোঝাতে তারা ’৭১ থেকে ’৭৫ সালকেই বুঝিয়ে থাকেন।

অধ্যাপনা তথা শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে পৌর চেয়ারম্যান ঠাকুরগাঁও পৌরসভার (তখন ছোট্ট পৌরসভা) চেয়ারম্যান পদ বেছে নেওয়া মির্জা ফকরুল কি এই তলাবিহীন ঝুড়ি’র প্রকৃত উৎস জানেন না? হয়তো জানেন, আবার নাও জানতে পারেন। ’৭২ সালের বিসিএস পাস, অতঃপর শিক্ষকতা থেকে সরে গিয়ে রাজনীতিকদের ফাইল বগলে ঘোরা আমলার সেটা না জানাও হতে পারে। তবে জানেন বলেই ধরে নিতে চাই। কারণ এমন জেনে শুনে অনেক মিথ্যাচার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নয়, স্বাধীনতার সম্ভাবনার সময় থেকেই শুরু হয়েছিল।

অধিকন্তু, কিসিঞ্জারের মিটিংটি যখন হয় তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হতে ১০ দিন বাকি। সুতরাং তলাবিহীন ঝুড়ি যদি তখনই হয় তাহলে সে দায় তো মুজিব সরকারের নয়, পেয়ারে পাকিস্তানের! না, হুজুগে বাঙালির এক কথা, যে ঢিল ছুড়ে দিয়েছি, দিছি। ফেরাফিরি নাই! চিলে কান নিয়ে গেছে বলে চিলের পেছনে ছুটছি, এখন আর কানে হাত দিয়ে দেখব না, চিলের পেছনে ছুটতেই থাকব।

জাতির এই চরিত্রটিই কাজে লেগেছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বেলায়। ওই আমেরিকাও বঙ্গবন্ধুর শাসন নিয়ে শঙ্কিত ছিল, ভালো চোখে দেখেনি। সে এক দীর্ঘ আলোচনা। সেদিকে না যাই। কিন্তু আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত গুজব, ভুল তথ্য প্রদান, রূপকথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল নেটওয়ার্ক তৈরি করে। মানুষকে দিয়ে তা গলাধকরণ করানো হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশে কোনো আগুন জ্বলে ওঠেনি। এটাই সত্য।

আজ যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতিবাদের খবর বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, গভীরভাবে খবর নিয়ে দেখেছি, তাও আসলে এক ধরনের ‘বাস্কেট কেস’- এরা অসহায় বোধ করছেন, এদের এখন সাহায্যের প্রয়োজন! যদি প্রতিষ্ঠা করা যায় যে বিরাট প্রতিবাদ করেছিলেন তাহলেই তো নিজে এখন প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন! তবে বিচ্ছিন্নভাবে যে দু-চারজন প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, তাদের অধিকাংশই নিভৃতে চলে গেছেন। ইট ইজ এ ট্র্যাজেডি!

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/এএসএম/ফারুক