আমানুর রহমানের জন্ম সুনামগঞ্জ হলেও বেড়ে ওঠা সিলেটে। তিনি সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক করেছেন। এরপর দেশে ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে পরপর দুটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। পাশাপাশি ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ পদে গুগলে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেন। ইন্টারভিউয়ের বিভিন্ন ধাপ পার হওয়ার পর ২০২২ সালের জুলাই মাসে চাকরির প্রস্তাব পান। সবশেষে গত ৭ নভেম্বর আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন ব্র্যাঞ্চে ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে যোগদান করেন।
Advertisement
তার গুগলে চাকরির গল্প, নতুনদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গুগলে চাকরি পেয়েছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?আমানুর রহমান: গুগলে জয়েন করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল। সত্যি বলতে, এত তাড়াতাড়ি জয়েন করতে পারব চিন্তা করিনি। কিন্তু জয়েন করতে পেরে খুবই খুশি হয়েছি।
জাগো নিউজ: কখন থেকে সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি মনোযোগ দিলেন?আমানুর রহমান: প্রোগ্রামিংয়ের শুরু ইউনিভার্সিটির প্রথম সেমিস্টার থেকেই। প্রথম থেকেই কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে ছিলাম। নতুন নতুন অ্যালগারিদম আর ডাটা স্ট্রাকচার শেখা এবং বাকিদের সঙ্গে কম্পিটিশন করতে খুবই ভালো লাগত। ভার্সিটির ৪ বছর এসব করেই কেটেছে। পাশাপাশি ভার্সিটির একাডেমিক প্রজেক্টগুলো করতে গিয়ে কিছুটা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট শেখা হয়ে যায়।
Advertisement
জাগো নিউজ: গুগলে চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন?আমানুর রহমান: আমার কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং ব্যাকগ্রাউন্ড এখানে মেজর রোল প্লে করছে। গুগলের ইন্টারভিউগুলোয় বেশিরভাগ রাউন্ডে এরকম সমস্যা সমাধান করতে হয়। শুধু ইন্টারভিউয়ারকে এক্সপ্লেইন করতে হয় যে, কীভাবে সল্যুশনটা চিন্তা করছি। আর কোড ক্লিন রাখতে হয়। ক্লিন কোড নিয়ে আমার অলরেডি আইডিয়া ছিল। যোগাযোগ দক্ষতা এবং ব্যাখ্যা করার প্রক্রিয়া উন্নতি করার জন্য pramp.com নামের সাইটে বেশ কয়েকটি মক ইন্টারভিউ দিয়েছি। পিয়ারদের ফিডব্যাকগুলো থেকে কিছু জিনিস উন্নতি করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি লিটকোডে প্রব্লেম সলভিং অনুশীলন করেছি। আর বিহ্যাভিওরাল এবং সিস্টেম ডিজাইন রিলেটেড কোশ্চেনের জন্য ইউটিউব এবং কিছু অনলাইন ব্লগ পড়েছি।
জাগো নিউজ: গুগলে কী ধরনের চাকরির সুযোগ আছে?আমানুর রহমান: গুগলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের সব ধরনের চাকরির সুযোগ আছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, প্রোডাক্ট ডিজাইনার, ইঞ্জিনিয়ার ম্যানেজার, রিক্রুটার, ডাটা সায়েন্স রিলেটেডসহ অনেক রোল আছে। যে কেউ careers.google.com ওয়েবসাইটে জবস দেখে অ্যাপ্লাই করতে পারবেন। গুগলের একটি ভিন্নতা হচ্ছে ৩০ দিনে ৩টির বেশি জবে অ্যাপ্লাই করা যাবে না। তবে ৩০ দিন পরে আবার ৩টি করা যাবে।
জাগো নিউজ: একজন নতুন গ্র্যাজুয়েট গুগলে চাকরির জন্য আবেদন করবেন কীভাবে?আমানুর রহমান: আবেদনের জন্যে careers.google.com ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করা যাবে। আরেকটি উপায় হচ্ছে গুগলে চাকরি করেন এমন কারো রেফারেল নেওয়া। নতুন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রথমেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রোলের ইন্টারভিউ পাওয়া কিছুটা কঠিন হবে। কিন্তু ইন্টার্নশিপ পাওয়া পসিবল। তা ছাড়া গুগল কোডেজম বা গুগল কিকস্ট্রার্ট কন্টেস্টগুলোয় ভালো পারফর্ম করলে বাকি রোলগুলোর জন্যও ইনভাইট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জাগো নিউজ: গুগলে ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি বলতেন—আমানুর রহমান: প্রথমেই আবেদনের মাধ্যমে শুরু হয়। এর ৩-৪ দিন পরই রিক্রুটার মেইল করে কলের জন্য। রিক্রুটার কলে ব্যাকগ্রাউন্ড, ইন্টারেস্ট, কিছু বেসিক এমসিকিউ এবং শূন্যস্থান পূরণ কোশ্চেনস জিজ্ঞেস করেন। এরপর ফোন স্কিনিং রাউন্ডের জন্য ইনভাইট পাই। আমি কিছু তারিখ দেওয়ার তিন সপ্তাহ পরের একটি তারিখ সিলেক্ট করা হয়। ফোন স্কিনিং রাউন্ডটি ৪৫ মিনিটের। শুরু হয় একটি ওয়ার্ম-আপ সমস্যা দিয়ে। তারপর মেইন প্রবলেম সলভ করতে দেয়। প্রবলেমগুলো সাধারণত লিডকোডের সহজ ও মধ্যম ক্যাটাগরির হয়। সমাধান দেওয়ার পর ফলোআপ কিছু প্রশ্ন করে। শেষে ইন্টারভিউয়ারকে কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করা যায়। আমিও গুগলে কাজ রিলেটেড কিছু প্রশ্ন করেছিলাম।
Advertisement
ইন্টারভিউটা আমার কাছে মনে হয়েছিল ভালো হয়েছে। নরমালি ফিডব্যাক ইন্টারভিউয়ের অল্প সময় পর দিয়ে দেয়। কিন্তু আমার কেসে ১৫ দিন লেগে যায়। পরে জানতে পারি, ইন্টারভিউয়ার সিক লিভে ছিলেন। কিন্তু অভারওল ফিডব্যাক ভালো ছিল এবং মেইন রাউন্ডের জন্য ইনভাইট পাই। ফাইনাল রাউন্ড ১ দিন অথবা ২ দিনে দেওয়া যায়। আমি ১ দিনে দেওয়ার প্ল্যান করি। ১ মাস পরে আমার ইন্টারভিউ ডেট ফিক্সড হয়। মেইন ইন্টারভিউতে ৫টি রাউন্ড ছিল। এর মধ্যে ৪টি ফোন স্কিনিংয়ের মতো কোডিং রাউন্ড আর ১টি বিহ্যাভিওরাল রাউন্ড। সবগুলোই ৪৫ মিনিটের ছিল।
মেইন রাউন্ডে ৪টি কোডিং রাউন্ডের প্রসেস ফোন স্কিনিং রাউন্ডের মতো হুবহু ছিল। বিহ্যাভিওরাল রাউন্ডটা একটু ভিন্ন। এখানে বিভিন্ন সিচুয়েশন বেজড প্রশ্ন করা হয়। মূলত টার্গেট হচ্ছে লিডারশিপ দক্ষতা এবং কালচার ফিটনেস কি না, তা জাজ করা। এখানে ১টি রাউন্ড আমার তখন হয়নি। ইন্টারভিউয়ার জয়েন করতে পারেননি কিছু কারণে। দশ দিন পরে সেটি নেওয়া হয়। এর ৪-৫ দিন পরেই রিক্রুটার আমাকে ফিডব্যাক জানান। ৪টিতেই ফিডব্যাক পজিটিভ ছিল। আর ১টিতে এভারেজ। অভারওল এটা ভালো ছিল এবং আমাকে টিম ম্যাচিং ধাপে নেওয়া হয়। টিম ম্যাচিং ধাপে বিভিন্ন টিমের ম্যানেজারের সাথে ক্যাজুয়াল কল হয়। টিম কী কী প্রজেক্টে কাজ করে, কাজের পরিবেশ কেমনসহ আরও কিছু জিনিস ম্যানেজার বলেন। আমার কোনো প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করছি। আর মাঝেমধ্যে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড আর ইন্টারেস্ট নিয়ে ম্যানেজাররা কিছু প্রশ্ন করেন। এ ধাপে একটু বেশি টাইম লেগেছে আমার। এটি ৫ মাস পরে শেষ হয়েছে। কিছু রোলে এটি ছাড়াই অফার দেয় এবং পরে টিম সিলেক্ট করা হয়। মাঝখানে আমার রিক্রুটারও পরিবর্তন হয়েছিল। এজন্য প্রসেসটা আরও লম্বা হয়ে গেছে। এরমধ্যে হায়ারিং কমিটি থেকেও অ্যাপ্রুভাল চলে আসে। অ্যাপ্রুভালের কিছুদিন পর একটি টিমের সাথে ম্যাচও হয়ে যায়। সবশেষে ২০২২ সালের জুলাইয়ে জব অফার পাই।
জাগো নিউজ: পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কতটা সময় লাগতে পারে?আমানুর রহমান: আমার কেসটা একটু ডিফারেন্ট ছিল। নরমালি গুগলে ৩-৪ মাস লাগে। আমার কেসে ৮ মাস লেগে গেল। ২০২১ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখ রিক্রুটার মেইল পাই। আর ২০২২ সালের জুলাইয়ের ৪ তারিখ ফাইনাল অফার করা হয়।
জাগো নিউজ: যেসব তরুণ গুগলে চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?আমানুর রহমান: ভালো কিছু প্রজেক্ট করা, অ্যালগারিদম এবং ডাটা স্ট্রাকচার ভালো আয়ত্তে রাখা। কোডিং কম্পিটিশনগুলোয় অংশগ্রহণ করা এবং একটি স্ট্রং সিভি বানানো। ফাইনালি লিটকোডের মতো সাইটে প্র্যাক্টিস করা এবং মক ইন্টারভিউ দেওয়া। কারো রেফারেল না পেলে নিজ থেকেই অ্যাপ্লাই করতে হবে। হাল না ছেড়ে চেষ্টা করে গেলে যে কোনো কোম্পানিতে হবেই। আরেকটি জিনিস হচ্ছে, প্রসেসটাকে পেইন পয়েন্ট না ভেবে উপভোগ করা। আর প্রত্যেকটি ইন্টারভিউ থেকে নিজের লেকিংসগুলো ফিগার আউট করা এবং উন্নতি করা।
জাগো নিউজ: গুগলে চাকরি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?আমানুর রহমান: আপাতত নিজেকে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। পাশাপাশি প্রচুর নলেজ গ্যাদার করতে চাই। এ ছাড়াও গুগলে ইম্প্যাক্টফুল কিছু করার ইচ্ছা আছে।
এসইউ/জিকেএস