অর্থনীতি

বিমায় আগ্রহ কমছে মানুষের!

বিমার প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও তা যেন খুব একটা কাজে আসছে না। বরং দিন দিন উল্টো পথে হাঁটছে দেশের বিমাখাত। ধারাবাহিকভাবে কমছে বিমার গ্রাহক সংখ্যা। কিছু জীবন বিমা কোম্পানিতে ব্যাপক অনিয়ম এবং গ্রাহকদের সময় মতো দাবির টাকা পরিশোধ না করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

তারা বলছেন, বিমা খাতের সব কোম্পনি খারাপ নয়। কয়েকটি কোম্পানি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। তারা গ্রাহকদের দাবির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি কোম্পানির অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক বিমা খাতে।

এমনিতেই বিমা খাতের এক ধরনের ইমেজ সংকট রয়েছে। তার মধ্যেই কিছু কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করা নিয়ে নানা গড়িমসি করছে। ফলে এসব কোম্পানিতে বিমা গ্রাহকের সংখ্যা কমছে। তবে যেসব কোম্পানি গ্রাহকদের দাবির টাকা সঠিক নিয়মে সময় মতো পরিশোধ করছেন, সেসব কোম্পানিতে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে।

আরও পড়ুন: টিকে থাকার লড়াইয়ে বেশিরভাগ নতুন জীবন বিমা কোম্পানি

Advertisement

অন্যদিকে, বিমা খাতে গ্রাহক কমার বিষয়টি ভাবাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) দায়িত্বশীলদের। যে কারণে বিমা কোম্পানিগুলো যাতে সঠিকভাবে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ করে সেজন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির দায়িত্বশীলদের।

একসময় দেশের ভেতরে প্রচারণা ছিল বিমা মানেই প্রতারণা। আর বিমা অধিদপ্তর ছিল দুর্নীতিতে ভরপুর। ফলে বিমা খাতে যেমন শিক্ষিত জনবল কম এসেছে, অন্যদিকে গ্রাহকের আস্থাও সৃষ্টি হয়নি।

আরও পড়ুন: সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই মিলছে না বিমা দাবির টাকা!

তবে, বর্তমান সরকার বিমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে ২০১১ সালে নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ গঠন করে। সেই সঙ্গে নতুন বিমা আইন ২০১০ প্রণয়ন করা হয়। বিমা পেশায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত (অ্যাকচুয়ারি) এম শেফাক আহমেদকে চেয়ারম্যান এবং ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উচ্চ আদালতের সাবেক রেজিস্ট্রারকে সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে শুরু হয় আইডিআএ’র কার্যক্রম।

Advertisement

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর পদক্ষেপে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বিমা খাতে। অনিয়মের খোলস ভেঙে অনেকটাই নিয়মের মধ্যে চলে আসে বিমা কোম্পানিগুলো। তবে পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সেই ভূমিকা আর দেখা যায়নি। এমনকি নানা অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে সম্প্রতি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এম মোশাররফ হোসেন।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানের নানা অনিয়মের পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানি বিমা দাবির টাকা পরিশোধে গড়িমসি করা এবং পলিসি গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে হয়রানির প্রবণতাও অব্যাহত রয়েছে। ফলে বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে। যে কারণে দেশের বড় অংশই বিমার আওতার বাইরে রয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে চলমান বিমা পলিসির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮ লাখ ৬০ হাজার। সে সময় জীবন বিমা কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৩১টি।

বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি এবং দেশি-বিদেশি মালিকানায় ৩৫টি কোম্পানি জীবন বিমা ব্যবসা করছে। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় রয়েছে একটি কোম্পানি এবং একটি কোম্পানি রয়েছে সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানাধীন। আর সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে একটি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এ কোম্পানিগুলোতে সচল বিমা পলিসির সংখ্যা ৭৩ লাখ ৮৩ হাজার।

অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর পলিসি সংখ্যা কমে অর্ধেকের নিচে চলে এসেছে। অথচ এ সময়ের মধ্যে একদিকে দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে অন্যদিকে বড় হয়েছে দেশের অর্থনীতি।

জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে গ্রাহক সংখ্যা একদিনে কমেনি। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৯ সালে দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর সচল পলিসি ছিল ৯৭ লাখ ৪০ হাজার। পরের বছর ২০২০ সালে তা কমে ৮৫ লাখ ৬০ হাজারে নেমে আসে। ২০২১ সালে তা আরও কমে ৮২ লাখ ৮০ হাজারে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন: সাবেক এমডি শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে ২৩৯ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ

গ্রাহক সংখ্যার (বিমা পলিসি বিক্রি) দিক থেকে সবার ওপর রয়েছে ন্যাশনাল লাইফ। আইডিআরএকে কোম্পানিটি যে তথ্য দিয়েছে, সেই তথ্যানুযায়ী— প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি করা পলিসির সংখ্যা ১৭ লাখ ৮ হাজার ৯৯৬টি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডেল্টা লাইফের পলিসি সংখ্যা ১২ লাখ ৫০ হাজার ৯৫২টি। ১০ লাখ ৯৫ হাজার ১৯২টি পলিসি বিক্রি করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেটলাইফ।

এছাড়া পপুলার লাইফের ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬২১টি, জীবন বীমা করপোরেশনের ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৯, ফারইস্ট লাইফের ৩ লাখ ১০ হাজার ৭১৯, মেঘনা লাইফের ২ লাখ ৯৪ হাজার ৫৫০, প্রগতি লাইফের ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩, সানলাইফের ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৬, সোনালী লাইফের ২ লাখ ৬ হাজার ৬২৩, প্রাইম ইসলামী লাইফের ১ লাখ ৯০ হাজার ৭৮৭, সন্ধানী লাইফের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৫ এবং রূপালী লাইফের ১ লাখ ২৪ হাজার ৬১৫টি পলিসি রয়েছে।

বাকি কোম্পানিগুলোর পলিসির সংখ্যা এক লাখের কম। এর মধ্যে হোমল্যান্ড লাইফের ৯০ হাজার ৫৪৭টি, সানফ্লাওয়ার লাইফের ৫১ হাজার ৭৪৮, আলফা ইসলামী লাইফের ৫০ হাজার ৩৪১, গার্ডিয়ান লাইফের ৩৯ হাজার ১৪৫, চার্টার্ড লাইফের ২৩ হাজার ১৪৯, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের ২০ লাখ ২০ হাজার ২৯৪, প্রগ্রেসিভ লাইফের ১৯ হাজার ৮৯৪, গোল্ডেন লাইফের ১৮ হাজার ৩৫৯, বেঙ্গল লাইফের ১৭ হাজার ২৭২, পদ্মা ইসলামী লাইফের ১৪ হাজার ৯৭২, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের ১৩ হাজার ৪১০ এবং জেনিথ ইসলামী লাইফের ১০ হাজার ১৬৮টি পলিসি রয়েছে।

এককভাবে ১০ হাজারের কম বিমা পলিসি থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেস্ট লাইফের ৯ হাজার ২৫১টি, স্বদেশ লাইফের ৭ হাজার ৯৭২, এনআরবি ইসলামিক লাইফের ৭ হাজার ৪৬০, লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশের ৭ হাজার ১৮২, ডায়মন্ড লাইফের ৪ হজার ৩৭৬, আকিজ তাকাফুল লাইফের ৩ হাজার ৯৭১, প্রটেক্টিভ ইসলামী লাইফের ৩ হাজার ৭৫৫, আস্থা লাইফের ৩ হাজার ৮৭ এবং যমুনা লাইফের ১ হাজার ৮১টি পলিসি রয়েছে।

আরও পড়ুন: সাধারণ বিমায় অর্ধেকের বেশি দাবি বকেয়া

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, আইডিআরএ শুরুর দিকে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে প্রায় সবকটি বিমা কোম্পানি নিয়মের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন। যার সুযোগ নিয়ে কয়েকটি বিমা কোম্পানি বড় ধরনের অনিয়ম করেছে। এতে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। আবার গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে বিমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়েনি। বরং কমেছে।

প্রগতী লাইফের সিইও মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, অন্য কোম্পানির অবস্থা আমি জানি না। তবে আমাদের কোম্পানির ব্যবসা কমেনি। আমাদের ব্যবসার সংখ্যা বাড়ছে। যদি ইন্ডাস্ট্রিতে (বিমা খাতে) পলিসি কম, তাহলে তো নিশ্চয়ই এটা ভালো লক্ষণ নয়। কারণ আমাদের দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, অর্থনীতি উত্তরোত্তর ভালো হচ্ছে। মানুষের মাথাপিছু আয় ও শিক্ষার হার বাড়ছে। বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে তো আমাদের পলিসি বাড়া উচিত।

কিছু কোম্পানি গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে গড়িমসি করছে। বিমা পলিসি কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা প্রভাব ফেলছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক কোম্পানির পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে, তারা দাবির টাকা দিতে পারেনি। ফলে মার্কেটে তাদের একটা দুর্নাম রয়ে গেছে। ফলে ওই কোম্পানিগুলো নতুন পলিসি খুব একটা করতে পারছে না। এ কোম্পানির সংখ্যা খুব একটা কম নয়। বিমা পলিসি কমার জন্য এটা একটা কারণ হতে পারে। গ্রাহকের দাবি পরিশোধ না করাই বিমা খাতের মূল সমস্যা।

তিনি বলেন, দাবি পরিশোধ না করার কারণে আমাদের ইমেজ সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এখন দাবি পরিশোধের বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। বিমা মেলায়ও তারা সব কোম্পানিকে বেশ জোরেশোরে দাবি পরিশোধ করার কথা বলেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হলো কিছু কোম্পানি দাবি পরিশোধ করবে, সেই টাকাই তাদের কাছে নেই। এমনকি তাদের কাছে পর্যাপ্ত সম্পদও নেই। ফলে চাপ দিলেও তাদের পক্ষে দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরও পড়ুন: জীবন বিমায় বকেয়া দাবির পাহাড়

আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান জয়নুল বারী বলেন, করোনার কারণে ২০১৯ ও ২০২০ সাল খারাপ গেছে। আমরা এখন অনেক ধরনের প্রোগ্রাম নিচ্ছি, প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। বিমা মেলা করেছি, সেমিনার করেছি। গ্রাহকদের দাবির টাকা যাতে সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয়, সেজন্য বিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছি। গ্রাহকরা যাতে দাবির টাকা পান সেদিকেই আমরা সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এক একটা কোম্পানিকে ডেকে নিয়ে আমরা দাবি পরিশোধের জন্য ডেটলাইন দিচ্ছি। এছাড়া নতুন নতুন পণ্য আনাসহ আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। আশাকরি, এ বছর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

এমএএস/এমএএইচ/এসএইচএস/জেআইএম